বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার শেষ প্রান্তে মাছ ধরার সময় গত ৯ ডিসেম্বর দুপুরে ৭৮ জেলে-নাবিকসহ দুটি ট্রলার জব্দ করে নিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় কোস্টগার্ড। ২৪ দিনেও তাদের দেশে ফেরানো সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে জেলে-নাবিকদের স্বজনরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। তারা কেমন আছেন, তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, কবে নাগাদ দেশে ফিরতে পারবেন—এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন স্বজনরা।
‘আমার ছেলে কেমন আছে, সে কখন দেশে ফিরবে এটি জানার জন্য প্রতিদিন ট্রলার মালিকের অফিসে যাচ্ছি। তারা প্রতিদিনই আমাকে ধৈর্য ধরতে বলছেন। তারা বলছেন চেষ্টা করছেন। কিন্তু আর কতদিন ধৈর্য ধরবো। দুশ্চিন্তায় আর ধৈর্য রাখতে পারছি না। ২৪ দিন ধরে ছেলে ভারতীয় কোস্টগার্ডের হাতে আটক। এর মধ্যে একবারও তার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। ছেলেটা কেমন আছে, কবে দেশে ফিরবে; তাও জানি না।’
বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা বলেছেন চট্টগ্রামের মো. আমির হোসেন। ভারতীয় কোস্টগার্ডের হাতে আটক বাংলাদেশি ৭৮ জেলে-নাবিকের মধ্যে রয়েছেন তার ছেলে মো. রিয়াজও। তিনি নগরের কর্ণফুলী থানার ইছানগর এলাকায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করেন।
৯ ডিসেম্বর দুপুরে বাংলাদেশের সমুদ্রে মাছ ধরার সময় দুটি ট্রলারসহ ৭৮ জন জেলে-নাবিককে ধরে নিয়ে যায় ভারতীয় কোস্টগার্ড। খুলনার হিরণ পয়েন্ট এলাকার অদূরে সমুদ্র থেকে ট্রলারসহ তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মালিকপক্ষ ও নৌপরিবহন অধিদফতর নিশ্চিত করেছিল ঘটনার পরদিন। আটক দুটি নৌযান হলো এফভি লায়লা-২ ও এফভি মেঘনা-৫। এফভি লায়লা-২ ট্রলারটি এস আর ফিশিং নামের প্রতিষ্ঠানের। আর এফভি মেঘনা-৫ ট্রলারটি সিঅ্যান্ডএফ অ্যাগ্রো লিমিটেডের মালিকানাধীন।
১১ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ‘ইন্ডিয়ান কোস্টগার্ড’ পেজে এক পোস্টে উল্লেখ করা হয়, ভারতীয় সমুদ্রসীমায় মৎস্য আহরণের অভিযোগে এক অভিযানে ট্রলার দুটিসহ ৭৮ নাবিককে আটক করা হয়েছে। তারা ভারতের ওডিশা রাজ্যের পারাদ্বীপে ভারতীয় কোস্টগার্ডের তত্ত্বাবধানে আছেন।
তারা কোথায় আছে, কেমন আছে; জানে না পরিবার
আমির হোসেন বলেন, ‘এফভি মেঘনা-৫ ট্রলারে আমার ছেলে রিয়াজ ছিল। গত ২৪ নভেম্বর মাছ ধরার জন্য সমুদ্রে যায়। এরপর থেকে কোনও খবর পাচ্ছিলাম না। ১০ ডিসেম্বর জানতে পারি, ভারতের কোস্টগার্ডের হাতে আটক হয়েছে। কিন্তু এরপর থেকে আর কোনও খবর নেই। কোথায় আছে, কেমন আছে, তাও জানি না। ঘরে তার স্ত্রী আমেনা খাতুন ও ১৪ মাসের মেয়ে রায়সা আক্তার রয়েছে। ছেলে আটক হয়েছে শোনার পর থেকে তার মা সাফিয়া খাতুন দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে। বারবার জানতে চাচ্ছে ছেলে কবে ফিরবে। কিন্তু আমি কোনও জবাব দিতে পারি না। ট্রলার মালিকের অফিসে গিয়েও কোনও সঠিক তথ্য পাচ্ছি না।’
রিয়াজের মতোই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন অপর নাবিক-জেলেদের স্বজনরাও। দিন কাটছে দুশ্চিন্তায়। মো. বেলাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাই মো. মিরাজ মেঘনা-৫ ট্রলারে ছিল। তার স্ত্রী রেশমা আক্তার আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্ত্রীর কিছু স্বর্ণ ছিল। সেগুলো বন্ধক রেখে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে সংসারের খরচ দিয়েছিল। বলেছিল, সাগর থেকে ফিরে টাকা শোধ করে স্বর্ণগুলো মহাজনের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনবে। এখন মিরাজের আসার অপেক্ষায় আছি আমরা। সংসার চালাতে তার স্ত্রী হিমশিম খাচ্ছে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মিরাজ দ্বিতীয়। আমাদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায়। আমরা কর্ণফুলী থানার ইছানগর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকি। ২৪ দিনেও ভাইকে ফেরানো যায়নি। কবে ফিরবে, তাও সুনির্দিষ্ট করে বলছেন না ট্রলার মালিক। আমরা মহা দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি।’
একই দুশ্চিন্তায় আছেন কর্ণফুলী থানার ইছানগর এলাকার মো. হারুন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে মো. রাকিব মেঘনা-৫ ট্রলারে ছিল। ভারতীয় কোস্টগার্ডের হাতে আটক হওয়ার পর তাদের ট্রলারের মালিকের কথামতো ছেলের জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, আমার জন্ম নিবন্ধন, পরিচয়পত্র ও ছবি জমা দিয়েছি। ট্রলারের মালিকের অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ভারতে আটক আমার ছেলেসহ বাকিদের ছাড়িয়ে আনতে চেষ্টা করছেন। ছেলের আসতে দেরি হওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে তার মাও।’
এক ট্রলারে ৪১ জন, আরেকটিতে ৩৭
ট্রলার মালিকদের দেওয়া তথ্যমতে, এফভি লায়লা-২ ট্রলারটি গত ২৭ নভেম্বর মাছ ধরার জন্য সাগরে যায়। ২০ ডিসেম্বর ঘাটে ফেরার কথা ছিল। ট্রলারটিতে ৪১ জন নাবিক-জেলে রয়েছেন। এফভি মেঘনা-৫ ট্রলারটি গত ২৪ নভেম্বর সাগরে যায়। ১৪ ডিসেম্বর ফিরে আসার কথা ছিল। এটিতে ৩৭ জন নাবিক-জেলে আছেন।
সিঅ্যান্ডএফ অ্যাগ্রো লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সুমন সেন বলেন, দুটি ট্রলার বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার এক নটিক্যাল মাইল ভেতরে মাছ ধরছিল। তখন ভারতীয় কোস্টগার্ড ট্রলার দুটি আটক করে নিয়ে যায়। জেলেদের আইনি প্রক্রিয়ায় উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি আমরা।
এস আর ফিশিংয়ের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) মিন্টু সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আটক নাবিক-জেলেসহ দুই ট্রলার ছাড়াতে আমাদের সমিতির নেতারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সব দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করছে বলে আমাদের জানিয়েছে।’
দ্রুত ফেরার আশা
৭৮ নাবিকসহ দুটি ট্রলার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে জানালেন চট্টগ্রাম সামুদ্রিক মৎস্য দফতরের পরিচালক মো. আবদুস ছাত্তার। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনা চলছে। আশা করছি, শিগগিরই তারা ফিরবেন। তবে জেলে-নাবিকরা নিরাপদে আছেন এবং সবাই সুস্থ আছেন।’
যা জানালো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (০২ জানুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আটক থাকা ৯৫ জন ভারতীয় জেলে ও নৌকর্মীকে তাদের দেশে পাঠানো হচ্ছে। অপরদিকে ভারতে আটক থাকা ৯০ জন বাংলাদেশি জেলে ও নৌকর্মীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। পারস্পরিক প্রত্যাবাসনের এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী ৫ জানুয়ারি এটা সম্পন্ন হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ৯৫ জন ভারতীয় জেলে ও নৌকর্মীকে ভারতীয় কোস্টগার্ডের কাছে হস্তান্তর করার এবং ভারতীয় কোস্টগার্ডের কাছ থেকে ৯০ জন বাংলাদেশি জেলে ও নৌকর্মীকে গ্রহণ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। একইসঙ্গে ভারতে আটক বাংলাদেশের দুটি ফিশিং ভেসেল এবং বাংলাদেশে আটক ভারতের ছয়টি ফিশিং বোটও হস্তান্তর করা হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, বাংলাদেশ পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয়ে আগামী ৫ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক জলসীমায় হস্তান্তর কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। আগামী ৬ জানুয়ারি বিকালে বাংলাদেশি জেলে ও নৌকর্মীরা তাদের ফিশিং ভেসেলসহ চট্টগ্রামে ফেরত আসবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।