জমির আইল ও মাছের ঘেরের বেড়িবাঁধে কুল চাষ করে সফলতা পেয়েছেন সাতক্ষীরার চাষিরা। এক বিঘা জমিতে ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ করে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার কুল বিক্রি করছেন তারা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আমের পাশাপাশি সাতক্ষীরার কুল বা বরইয়ের সুনাম আছে। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় কুল চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। অল্প সময়ে অধিক লাভ হওয়ায় প্রতি বছর বাড়ছে কুল চাষ। জেলার চাহিদা মিটিয়ে শত শত মণ কুল যাচ্ছে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
তালা উপজেলার মিঠাবাড়ি এলাকার কৃষক আব্দুল গাফফার বলেন, ‘১০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের কুল চাষ করেছি। মৌসুমের শুরুতে ১০০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। এখন বিলাতি কুলের কেজি ৮০-৯০ টাকা। সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন ৪০০-৫০০ মণ কুল যাচ্ছে।’
একই এলাকার কুল চাষি আবুল হোসেন বলেন, ‘চলতি মৌসুমে বল সুন্দরী, আপেল কুল, বাউকুল, নারিকেল ও থাইকুলের চাষ করেছেন এই এলাকার চাষিরা। সব ধরনের কুল প্রতি বিঘায় ৯০-১০০ মণ পাওয়া যায়। গাছ রোপণ, বাগান পরিচর্যা, ওষুধ ও কীটনাশকসহ প্রতি বিঘায় ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। ফলন ভালো হলে খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বিঘায় দুই লক্ষাধিক টাকার বেশি লাভ হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরার সাত উপজেলায় জমির আইল ও মাছের ঘেরের বেড়িবাঁধে সারি সারি কুল গাছ রোপণ করা হয়েছে। আকারে গাছগুলো ছোট। চার-পাঁচ ফুট লম্বা। কুলের ভারে মাটিতে শুয়ে পড়ে গাছগুলো। প্রতিদিনই কুল তুলছেন চাষিরা। কুল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলায় ৬৫৪ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার কুলের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১০৪ হেক্টর, কলারোয়ায় ৩১৬ হেক্টর, তালায় ১৫৮ হেক্টর, দেবহাটায় ১৬ হেক্টর, কালীগঞ্জে ২০ হেক্টর, আশাশুনিতে ১৫ হেক্টর ও শ্যামনগরে ২৫ হেক্টর। এসব কুলের মধ্যে রয়েছে বাউকুল, আপেল কুল, নাইন্টি কুল, নারিকেল কুল, বিলাতি কুল, মিষ্টিকুল ও টককুল। প্রতি বিঘায় ৯০-১০০ মণ উৎপাদন হয় জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
কলারোয়া উপজেলার বলাডাঙা এলাকার কুল চাষি আরিফ হোসেন বলেন, ‘গত ১২ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের কুল চাষ করি। এবার আট বিঘা জমিতে চাষ করেছি। চলতি মৌসুমে জমিতে বল সুন্দরী, নারিকেল ও আপেল কুল চাষ করেছি। গাছে স্প্রে, সার ও পোকা দমনের ওষুধসহ বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। বছরে ফল বিক্রি করে আয় হয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।’
সদরের কুল চাষি শাহাজান আলী বলেন, ‘এবার চার বিঘা জমিতে বল সুন্দরী, ভারতী সুন্দরী, নাইন্টি ও মিষ্টি কুল চাষ করেছি। এ পর্যন্ত দুই লাখ টাকার কুল বিক্রি করেছি। প্রতি মণ কুল পাইকারিতে বিক্রি করছি তিন হাজার টাকা। বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা এসে কুল কিনে নিয়ে যান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে চার বিঘা জমির দুই প্রজাতির কুল পাঁচ-ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবো।’
এদিকে, জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টিকুল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০-১০০ টাকা। সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের পাশে বাগান থেকে কুল নিয়ে বিক্রি করছেন চাষিরা। চলতি পথে অনেকে গাড়ি থেকে নেমে কুল কিনে বাড়ি ফিরছেন।
আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে একজন ক্রেতা বলেন, পরিবার নিয়ে গোপালগঞ্জ থেকে সুন্দরবন বেড়াতে এসেছিলাম। ফেরার পথে রাস্তার পাশে কুল বিক্রি হচ্ছে দেখে পাঁচ কেজি কিনেছি। সাতক্ষীরার কুলের সুনাম আছে। খেতে অনেক সুস্বাদু।
উন্নয়ন প্রচেষ্টার কৃষিবিদ নয়ন হোসেন বলেন, তালা উপজেলায় অন্যান্য কুলের পাশাপাশি এবার সাড়ে নয় বিঘা জমিতে আগাম জাতের টক-মিষ্টি কুলের চাষ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। আগাম ফলন হওয়ায় ১০০-১৩০ টাকা কেজি বিক্রি করেছেন চাষিরা। আগামী বছর এই কুলের চাষ আরও বাড়বে।
তালার নগরঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান লিপু বলেন, কৃষক ধান চাষ করে অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হন। তার পরিবর্তে কম খরচে ফসলি জমি ও মাছের ঘেরের বেড়িবাঁধে কুল চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষের দিকে ঝুঁকছেন চাষিরা।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরার কুল বেশ সুস্বাদু, মিষ্টি ও পুষ্টিকর। জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রতি মৌসুমে সাতক্ষীরা থেকে শত শত মণ কুল চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর সাতক্ষীরায় কুলের ভালো ফলন হয়েছে। কৃষকরা ভালো দাম পাচ্ছেন। ফলে এবার কুল চাষিরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। আমরা কুল চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করি। লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছর আবাদ বাড়ছে।