চট্টগ্রাম মহানগরীকে জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্ত করতে প্রায় ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে কোনোটি সাত বছর আবার কোনোটি দশ বছর ধরে চলছে। প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করার দাবি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। এতে খরচ হয়ে গেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। তারপরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না নগরীর বাসিন্দারা। হালকা কিংবা মাঝারি বৃষ্টিতেও ডুবছে চট্টগ্রাম নগরী। যতবার বৃষ্টি হয় ততবারই ডোবে। জলাবদ্ধতায় পানিবন্দি হয়ে পড়েন নগরবাসী। পানি ঢোকে বাসাবাড়ি থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। নষ্ট হয় মজুত পণ্য।
চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতার দুঃখ ঘোচাতে ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক সিডিএর মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৭০ শতাংশ। প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। এক হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ। এতে ব্যয় হয়েছে ৪৪৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। দুই হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এতে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ২৪২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া এক হাজার ৩৬২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরের বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পে এক হাজার ৩২২ কোটি ৮ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প
চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট শর্তসাপেক্ষে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে সিডিএ। ওই বছরের ২৮ এপ্রিল থেকে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড প্রকল্পের কাজ শুরু করে। প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রাম নগরীর ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টির সংস্কার ও সম্প্রসারণের কথা রয়েছে। বর্তমানে ২১টি খালের কাজ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বাকি কাজ চলমান। ছয়টি খালের মধ্যে পাঁচটির মুখে পাম্প বসানো হয়েছে। বিভিন্ন খালের পাশে ১২১ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের কাজ ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে এ প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার ব্যাপারে আশাবাদী সিডিএর প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাঈনুদ্দীন।
সিডিএ’র প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রকৌশলী কাজী কাদের নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে– নগরীর খালগুলো পরিকল্পিত পুনর্খনন, সম্পসারণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, গুরুত্বপূর্ণ খালগুলোর পাড়ে রাস্তা নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও খালগুলো পরিষ্কার করার স্থায়ী ব্যবস্থা করা, খালের সঙ্গে সংযোগকারী পাকা ড্রেনগুলো সংস্কার ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা, নিচু ব্রিজগুলো প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে পানিপ্রবাহের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ ও পরিবেশের উন্নয়ন ও ভারসাম্য রক্ষা করা।’
চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্প
২০১৯ সালে একনেকে অনুমোদন পাওয়া এক হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ের পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। কয়েক দফা সময় বাড়ানোর পরও এ প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩০ শতাংশ। এ প্রকল্পের পুরো কাজ ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ করতে পারবেন বলে আশাবাদী প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প কর্মকর্তা ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম দাশ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ। কালুরঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। ১৫ নম্বর ঘাট পর্যন্ত এ প্রতিরোধ দেওয়াল নির্মাণ করার কথা ছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণে ১৫ নম্বর ঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত ১২ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দেয়াল নির্মাণ হবে না। শুধু কালুরঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার বন্যা প্রতিরোধ দেওয়াল হবে। পতেঙ্গা এলাকায় এ প্রকল্পের কিছু কাজ হবে।’
তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্পের আওতায় নগরীর ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর বসানোর পাশাপাশি কর্ণফুলীর তীরে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের কথা। কাজ চলমান আছে। এর মধ্যে মাত্র চারটি রেগুলেটরের ভৌত কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং একটির কাজ চলছে। চলতি বছরের জুন মাসে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ করা যাবে বলে আশা করছি।’
কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প
২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল একনেকের সভায় এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০২০ সালে শেষ করার কথা ছিল। পরে সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার কথা থাকলেও আবারও সময় বাড়ানোর আবেদন গেছে মন্ত্রণালয়ে। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পে ব্যয় ৪৬৯ কোটি টাকা বেড়ে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সিডিএ সূত্র জানায়, প্রকল্পটির কাজ ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর শুরু করে সিডিএ। নগরীর চাক্তাই, খাতুনগঞ্জসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকার জলবদ্ধতা নিরসনে ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউজ স্থাপনের কথা রয়েছে প্রকল্পের অধীনে। বর্তমানে ১০টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউজ বসানের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি দুটি খালের মুখে রেগুলেটর বসানোর কাজ চলমান আছে। সিডিএ’র এই প্রকল্পের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর তিন দফা প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। এরই মধ্যে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কালুরঘাট থেকে চাক্তাই পর্যন্ত এলাকার মানুষকে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করার জন্য সাড়ে আট কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। এ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ জটিলতা, সময়মতো অর্থ ছাড় না পাওয়া, কোভিড পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পে ধীর গতি হয়েছে।’
বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্প
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ১৯৯৫ সালে করা ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত দুই দশমিক নয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের খালটি খননের সুপারিশ করা হয়। ২০১৪ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ ব্যয়ে বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। তবে ওই সময় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় এবং জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারেনি সিটি করপোরেশন।
এরপর ২০১৭ সালের নভেম্বর একনেকে প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা করে আবারও অনুমোদন দেওয়া হয়। সংশোধনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। এ সময় এক লাফে এ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয় এক হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। গত বছরের ১৯ এপ্রিল সবশেষ সংশোধনে প্রকল্প ব্যয় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে প্রকল্প হয়েছে এক হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। প্রকল্পের চার বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম বলেন, ‘২ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি হবে ৬৫ ফুট চওড়া। খালের দুই পাশে ২০ ফুট করে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি রাস্তা হবে এবং ছয় ফুট প্রস্থের দুটি করে ওয়াকওয়ে হবে। বারইপাড়া হাইজ্জারপুল থেকে শুরু হয়ে খালটি নূর নগর হাউজিং, ওয়াইজের পাড়া, বলিরহাটের বলি মসজিদের উত্তর পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে মিশবে। প্রকল্পের কাজ চলমান আছে।’