কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালসহ জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সরকারিভাবে ইনজেক্টেবল স্যালাইন সরবরাহের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রোগীদের বাইরে থেকে দুই-তিনগুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাও সহজে মিলছে না। শহর ঘুরে দুই-একটি ফার্মেসিতে স্যালাইন মিললেও গুনতে হচ্ছে গায়ে উল্লেখিত মূল্যের দ্বিগুণ-তিনগুণ দাম। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী এবং ওষুধ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রৌমারীর মাছ বিক্রেতা অনন্ত দাস (৪০) দুই দিন আগে পেটের ব্যথা নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। চিকিৎসক স্যালাইন দিতে বললে বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। সুস্থ না হওয়ায় পরিবারের লোকজন তাকে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। এখানেও চিকিৎসক ‘ডিএনএস ৫ %’ স্যালাইন লিখে দেন। হাসপাতালে না পেয়ে অনন্তের ছোট ভাই চন্দ্র দাস কয়েকটি ফার্মেসি ঘুরে একটিতে স্যালাইনের খোঁজ পান। ডেক্সট্রোসাল নামের ওরিয়ন ফার্মার এই স্যালাইন দ্বিগুণ দামে কিনতে হয়েছে তাকে।
শনিবার (০৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে দেখা হলে চন্দ্র দাস বলেন, ‘কোনও হাসপাতালে স্যালাইন নাই। বাইরে থেকে ২০০ টাকা দাম দিয়ে কিনতে হলো। ফার্মেসিগুলোতে বেশি দাম রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলে কিছু করার নাই। রোগী হাসপাতালে ভর্তি, টাকার হিসাব তো করি নাই। আমাদের তো লাগবে, এজন্য বেশি দাম দিয়েই কিনেছি।’
সরকার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে চন্দ্র দাস বলেন, ‘এগুলাতো (স্যালাইন) রোগীর জন্য জরুরি। হাসপাতালে সবসময় থাকা দরকার। এটা সরকার দিচ্ছে না কেন, তা আমার জানা নেই।’
একই ওয়ার্ডে কথা হয় সদর উপজেলা মডেল মসজিদের খাদেম মহিবুর রহমানের (২২) সঙ্গে। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় শনিবার দুপুরে হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসক স্যালাইন দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা মাদ্রাসাশিক্ষার্থী আসাদুল ইসলাম হাসপাতালের সামনের ফার্মেসিগুলোতে কয়েক দফা খুঁজেও স্যালাইন পাননি। পরে কিছুটা দূরের এক ফার্মেসিতে পেয়েছেন। ওরিয়ন ফার্মার ‘হার্টম্যান সলিউশন’ নামের ৯২ টাকার এই স্যালাইনের ৩০০ টাকায় কিনেছেন আসাদুল।
এ ব্যাপারে আসাদুল বলেন, ‘গায়ের দামের চেয়ে বেশি দাম কেন জিজ্ঞাসা করলে বিক্রেতা বলেন, স্যালাইন সংকট, এজন্য দাম বেশি। রোগী বাঁচাতে বাধ্য হয়ে ৩০০ টাকায় কিনে নিয়ে আসছি।’
শুধু ওরিয়ন ফার্মার ‘হার্টম্যান’ কিংবা ‘ডেক্সট্রোসাল’ স্যালাইন নয়, নরমাল স্যালাইন ও ডিএ স্যালাইনসহ জীবনরক্ষাকারী অতিপ্রয়োজনীয় এই চিকিৎসা পণ্যের সংকটে রোগী এবং তাদের স্বজনদের হাহাকার চলছে। হাসপাতালে তো বটে, বাইরের ফার্মেসিগুলোতেও মিলছে না এই ওষুধ। শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত খুঁজে সৌভাগ্যবশত দুই একটি দোকানে পাওয়া গেলেও গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ দাম।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন সরবরাহ করে থাকে। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে চাহিদামতো স্যালাইন সরবরাহ করছে না তারা। ফলে সরবরাহে স্মরণকালের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এজন্য সর্বত্র সংকট।
হাসপাতালের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসে সাড়ে ছয় হাজার পিস চাহিদার বিপরীতে ডিএনএস স্যালাইন পাওয়া গেছে এক হাজার পিস। নরমাল স্যালাইন পাঁচ হাজারের বিপরীতে ৫০০ পিস, হার্টম্যান সলিউশন আট হাজারের বিপরীতে ১০০ পিস এবং কলেরা স্যালাইন পাঁচ হাজারের বিপরীতে পাওয়া গেছে এক হাজার পিস। তবে ডিএ স্যালাইন এক পিসও পাওয়া যায়নি। অথচ প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন জেনারেল হাসপাতালে। তাদের স্যালাইন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাইরে থেকে কিনতে বলা হচ্ছে রোগীদের।
সংকটের কথা স্বীকার করে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শাহীনুর রহমান সরদার বলেন, ‘স্যালাইনের সংকট চলছে। আমরা হিমশিম খাচ্ছি। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে।’
ওষুধ ব্যবসায়ীরা বলছেন, অপসো, ওরিয়ন, লিবরা ও পপুলার নামের কয়েকটি কোম্পানি ইনজেক্টেবল স্যালাইন সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন দিচ্ছে না কোম্পানিগুলো। কিছু কোম্পানির প্রতিনিধি দোকানেও আসছেন না। তারা বলছেন, কোম্পানিগুলো সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইনের তীব্র সংকট চলছে। এটি দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের।
জেলা শহরের হাসপাতাল মোড়ের ওষুধ ব্যবসায়ী লাতুল বলেন, ‘কোম্পানি স্যালাইন না দিলে আমরা কী করবো। কোম্পানির প্রতিনিধিরা আমাদের বলেন, দেশে ডলার সংকট। কাঁচামাল কিনতে না পারায় স্যালাইন উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। যে দুই-চারটা স্যালাইন দেয়, তা এক ঘণ্টাও দোকানে থাকে না। দিনভর রোগী ও স্বজনরা দোকানে এসে ফেরত যান। জেলার সব ফার্মেসিতে একই অবস্থা।’
হাসপাতাল মোড়ের আরেক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কিছু ফার্মেসি স্যালাইন রেখেও বিক্রি করছে না। আবার বিক্রি করলেও বেশি দাম নিচ্ছে। তারা সংকটকে পুঁজি করে বেশি মুনাফা নিচ্ছে।’
জেলার পুরাতন পশু হাসপাতাল মোড়ের ওষুধ ব্যবসায়ী আশরাফুল হক বলেন, ‘প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে ওষুধের ব্যবসা করছি। তারও আগে থেকে বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করেছি। কিন্তু এবারের মতো এমন স্যালাইন সংকট আগে কখনও দেখিনি। গত দুই মাসে শুধু একবার ১২ পিস স্যালাইন পেয়েছি। কোম্পানিগুলো বলছে, তারা উৎপাদন করতে পারছে না। আবার ঢাকায় চাহিদা বেশি থাকায় জেলাগুলোতে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। আসলে ভেতরে ভেতরে কী হচ্ছে, তা জানি না।’
তবে স্যালাইন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলছেন, স্যালাইনের চাহিদা বেড়ে গেছে। সরকারও কোম্পানিগুলো থেকে কিনছে। ফলে সংকট দেখা দিয়েছে জেলাগুলোতে।
ওরিয়ন ইনফিউশন কোম্পানির সিনিয়র বিক্রয় প্রতিনিধি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘কিছুটা সংকট আছে। কেন সংকট, তা বলতে পারবো না। তবে যে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে, তাতে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।’ সরকারি হাসপাতালের রোগীদের বাইরে থেকে স্যালাইন কেনার কারণে চাহিদা আরও বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
ফার্মেসিগুলোতে দ্বিগুণ-তিনগুণ দাম নেওয়ার বিষয়ে এই বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, ‘তা বলতে পারবো না। আমরা তো দাম বেশি রাখছি না, সে সুযোগ নেই। বিক্রেতারা কেন দাম বেশি নিচ্ছেন, তা তারাই ভালো জানেন।’
অপসো স্যালাইনের বিক্রয় প্রতিনিধি রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্যালাইনের তীব্র সংকট চলছে। মাঝেমধ্যে অল্প পরিমাণ সরবরাহ পাচ্ছি আমরা। কেন সংকট, তা বলতে পারবো না। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো আমরা জানি না। এটা কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।’
স্যালাইন সংকটের সার্বিক বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো.মঞ্জুর-এ-মুর্শেদ বলেন, ‘স্যালাইন সংকট চলছে। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সবখানে সরবরাহ সংকট। কেন সংকট, তা জানি না।’