আকস্মিক বন্যায় টানা ৫ দিন পানিবন্দি হয়ে আছেন চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে ২ লাখেরও বেশি মানুষ। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফেনী নদীর পানির উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বুধবার থেকে উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ১৬৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এসব ইউনিয়নে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। উপজেলার গ্রামীণ সড়কগুলো পানিতে ডুবে থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে আসা পানিবন্দিদের মাঝে পৌঁছানো যাচ্ছে না ত্রাণ। ফেনী-কুমিল্লার কয়েকটি অংশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পানি ওঠায় দেখা দিয়েছে তীব্র যানজট। বড় ধরনের উদ্ধার অভিযান ও পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না পেলে চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বেচ্ছাসেবী ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা।
একদিকে বন্যায় পানিবন্দি লাখো অসহায় মানুষ, অন্যদিকে ফেনী নদীর ভাটিতে অবস্থিত দেশের বৃহত্তর সেচ প্রকল্প মুহুরীর দুটি গেইট পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। অকেজো হয়ে আছে আরও দুটি গেইট। এ কারণে একদিকে জোয়ারের সময় ফেনী নদী হয়ে অভ্যন্তরে ঢুকছে বঙ্গোপসাগরের পানি। আবার ভাটার সময় দুটি গেইট অকেজো থাকার কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে।
মুহুরী প্রকল্পের গেইট ভেঙে যাওয়ার বিষয়ে জানতে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদ শাহরিয়ারকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে গত কয়েকদিন বন্যার কারণে দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে বিবেচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যান চলাচল করছে অনেক ধীরগতিতে। গত কয়েকদিন পথে আটকে থাকায় মালবাহী অনেক যানবাহনে থাকা নিত্য প্রয়োজনীয় কাঁচা ভোগ্যপণ্য নষ্ট হয়ে গেছে।
গত বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) কুমিল্লা জেলার চান্দিনা বাজার থেকে এক ট্রাক কাঁচা শাক-সবজি নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন চালক রিয়াজ উদ্দিন। তিনি রবিবার বেলা ১২টার দিকে মীরসরাইয়ের বারইয়ারহাট এলাকায় পৌঁছেছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজারের কয়েকজন পাইকারি বিক্রেতা কুমিল্লার চান্দিনা বাজার থেকে কাঁচা মরিচ, ধনিয়া পাতাসহ বেশ কিছু শাক-সবজি নিয়ে ট্রাক লোড করেন। কিন্তু গত তিন দিনেরও বেশি সময় ফেনীর লেমুয়া এলাকায় আটকে থাকায় সব কিছু পচে নষ্ট হয়ে গেছে।’
বন্যার কারণে চট্টগ্রামে রেলপথ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। ফেনীর লালপোল এলাকায় মহাসড়কের ওপর দিয়ে তীব্র স্রোতে পানি গড়ানোর ফলে যানবাহনও চলাচল করতে পারছে না। বন্যার্তদের সহায়তায় সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে এসেছে। এতে করে এখানকার দোকানগুলোতে শুকনো খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্রের ওপর চাপ পড়েছে। মীরসরাই উপজেলার বাজারগুলোতে বন্যার প্রভাবে ও সরবরাহ কমে শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। উপজেলার কোনও বাজারে দুদিন আগে থেকেই চিড়া, মুড়ি ও গুড় পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে সবজি থাকলেও বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। এছাড়া আলু, পেঁয়াজ কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা।
মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানার অফিসার ইনর্চাজ (পরিদর্শক) সোহেল সরকার জানান, রবিবার বিকাল পর্যন্ত মীরসরাইয়ের মিঠাছরা বাজার ঢাকামুখী লেন গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল। মহাসড়কের ফেনী অংশে প্লাবিত হওয়ায় গাড়ি চলাচল করছে অত্যন্ত ধীরগতিতে।
হাইওয়ে পুলিশের ফাজিলপুর হাইওয়ে থানার অফিসার ইনর্চাজ (পরিদর্শক) রাশেদ চৌধুরী জানান, চট্টগ্রামমুখী লেনে মুহুরীগঞ্জ ও লেমুয়ায় এখনও পানি রয়েছে, তাই এই লেনে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে। পানি কমে গেলে এই লেনে গাড়ি চলাচল শুরু হবে।
উপজেলার উপকূলীয় ঝুলনপুল বেণীমাদব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ খাঁন জানান, শুক্রবার সকাল থেকে স্কুলে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। শনিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত এখানে এক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এলাকার সবগুলো টিউবওয়েল পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। আশ্রিত মানুষের খাবারেরও সংকট রয়েছে।
মীরসরাই উপজেলা দুর্যোগ মোকাবেলায় গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য, মীরসরাই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির খাঁন জানান, রবিবার সকাল ১১টা পর্যন্ত উপজেলার ৭৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। অনেকেই আবার আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতেও আশ্রয় নিচ্ছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে মীরসরাই উপজেলা প্রশাসন ত্রাণ কার্যক্রম মনিটরিং করছে।
মীরসরাই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রশান্ত চক্রবর্তী সর্বশেষ বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে জানান, শনিবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। কিছু কিছু এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, যুব রেডক্রিসেন্ট অ্যালামনাই, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং শিক্ষার্থীরা পৃথক পৃথকভাবে বানভাসী মানুষদের উদ্ধার এবং তাদের মাঝে বিশুদ্ধ পানীয়, ওষুধ ও খাবার বিতরণ করছেন।
চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ বারইয়ারহাট জোনাল অফিস এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হেদায়েত উল্যাহ ও মীরসরাই জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আদনান আহমেদ জানান, কিছু কিছু এলাকায় পানির তীব্রতা কমে যাওয়ায় বিদ্যৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছে। এখনো বন্যাকবলিত অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎসেবা দেওয়া যাচ্ছে না। প্রায় ৪০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছে।