ফোর পিক স্টোরে (জাহাজের রশি, নোঙর, স্পেয়ার পার্টস রাখার স্থান) জমে থাকা গ্যাস থেকেই বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) তেলবাহী জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতিতে তীব্র বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায়। সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টায় ডলফিন জেটিতে ওই জাহাজে আগুনের ঘটনায় গঠিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে চার দফা সুপারিশ করা হয়।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ হাসনাতকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের এ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজের সম্মুখভাগে অবস্থিত ফোর পিক স্টোর থেকে বিস্ফোরণের ফলে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। ওই ফোর পিক স্টোরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস জমা হওয়ার কারণে এ ধরনের তীব্র বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে জাহাজের সম্মুখভাগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুর্ঘটনার আগে জাহাজ থেকে প্রায় ৮০০ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল খালাস সম্পন্ন হয়। জাহাজটিতে আরও ১০ হাজার ৯১৬ দশমিট ৮৪৬ মেট্রিক টন কার্গো নিরাপদে রয়েছে। কার্গো খালাস সম্পন্ন করতে প্রায় ২২ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হবে। কার্গো খালাস সম্পন্ন করা হলে জাহাজটি মেরামত বা সংস্কারের উদ্দেশ্যে সরিয়ে নেওয়া হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আবুধাবী থেকে আমদানি করা প্রায় ৯৮ হাজার ৩৮৩ মেট্রিক টন মারবান ক্রুড অয়েলবাহী মাদারভ্যাসেল ‘ওমেরা ল্যাগাসি’ ১৭ সেপ্টেম্বর কুতুবদিয়া বহির্নোঙরে আসে। সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে জাহাজটি থেকে ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) খালাসের কাজ শুরু হয়। প্রায় ৮০০ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল খালাসের পর বিস্ফোরণের পর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
ফোর পিক স্টোরে ডেক ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহা, বিএসসির ফোরম্যান নুরুল ইসলাম ও শ্রমিক মো. হারুন রুটিন কাজ করতে গেলে সেখানে জমে থাকা অতিরিক্ত দাহ্য গ্যাসের কারণে বিস্ফোরণ হয়। এতে তারা মারা যান।
বিএসসি সূত্রে উল্লেখ করা হয়, জাহাজে থাকা অবশিষ্ট কার্গো খালাসের লক্ষ্যে জাহাজের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের জন্য বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রতিনিধি পরিদর্শন করবেন। জাহাজটি নিরাপদ হিসেবে প্রত্যায়িত হলে জাহাজের অন্যান্য মেশিনারিজ ঠিক থাকা সাপেক্ষে কার্গো খালাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এমটি বাংলার জ্যোতি ও এমটি বাংলার সৌরভ জাহাজ দুটি ১৯৮৭ সালে নির্মিত। জাহাজ দুটির আয়ুষ্কাল প্রায় ৩৭ (সাঁইত্রিশ) বছর। এই দুটি জাহাজের বিকল্প জাহাজ দেশের অভ্যন্তরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ ধরনের জাহাজের বিকল্প না থাকায় জাহাজ দুটি যথাযথ মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে চালু রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া তদন্ত কমিটির পক্ষে করা সুপারিশগুলো হলো– দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন, ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ ও বিদ্যমান লাইটার জাহাজ দুটি ব্যবহারের উপযুক্ততা নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি কারিগরি কমিটি গঠনের জন্য বিএসসিকে অনুরোধ করা যেতে পারে। বিএসসির লাইটার জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতি ও এমটি বাংলার সৌরভ ব্যবহার করে ক্রুড অয়েল লাইটারিং কার্যক্রম পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমদানি করা ক্রুড অয়েল খালাসের জন্য সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন অবিলম্বে চালু করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণে (ওঅ্যান্ডএম) ঠিকাদার নিয়োগ দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা গেলে নিরাপদে ক্রুড অয়েল খালাস করা সম্ভব হবে। এসপিএমের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাস কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওঅ্যান্ডএম ঠিকাদার নিয়োগ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজকে কার্যকরভাবে ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হবে কিনা বা সম্ভাব্য বিকল্পের বিষয়ে বিএসসির মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে। জেটিগুলোতে থাকা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আরও আধুনিকায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
তদন্ত কমিটির বাকি ছয় সদস্য হলেন– ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যানিং ও শিপিং) মো. মোস্তাফিজার রহমান, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন অ্যান্ড অপারেশন) ক্যাপ্টেন জামাল হোসেন তালুকদার, বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মো. জাহিদ হোসাইন, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরী, পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আসিফ মালিক এবং যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) মো. হেলাল উদ্দিন।
তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মো. জাহিদ হোসাইন। তিনি বলেন, ‘তদন্ত শেষে সোমবার রাতের মধ্যেই আমরা প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’