স্বাধীন বাংলার অন্যতম রূপকার সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের বীরদামপাড়া গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর পালন করেন শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্বও। সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন গ্রামের বাড়ি বীরদামপাড়ায়। অকৃত্রিম ভালোবাসায় মিশতেন সবার সঙ্গে। তাই গ্রামের প্রবীণরা আজও ভুলতে পারেন না তাকে। গ্রামবাসীর হৃদয়ে স্বজনের মতো জায়গা করে আছেন এই সংগ্রামী নেতা।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতীয় চার নেতা। তাদেরই একজন দেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি কিশোরগঞ্জের কৃতি সন্তান। কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় নেতা, একান্ত আপনজন। তাকে হারানোর কষ্ট আজও ভুলতে পারেননি স্বজন ও নেতাকর্মীরা। বছর ঘুরে বিষাদের দিন হয়ে তেসরা নভেম্বর হাজির হয় তাদের কাছে।
তার স্মৃতিঘেরা বাড়িটি বর্তমানে জরাজীর্ণ। বাড়িজুড়ে অযত্ন-অবহেলার ছাপ। ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জীবিতকালে মাঝেমধ্যে আসতেন বাড়িতে। এখন পরিবারের কেউ আর বাস করেন না সেখানে। সৈয়দ নজরুলের স্মৃতিস্মারক বলতে কিছু নেই বাড়িতে। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা দেখাশোনা করে বাড়িটি। গ্রামের লোকজন বলছেন, সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ি ঘিরে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হোক, যেখানে তাঁর স্মৃতি, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিষয়গুলো মূর্ত হয়ে থাকবে। যা দেখে উদ্বুদ্ধ হবে নতুন প্রজন্ম।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী মো. আজিজুল হক। সেদিনের ঘটনা মনে পড়লেই তার চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি বলেন, ‘এভাবে প্রিয় নেতাকে হারাবো কখনও ভাবিনি। জেল হলো একটি নিরাপদ জায়গা সেখানে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয় আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে। স্বাধীন বাংলার বিনির্মাণে ওনার ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমরা ওনার এমন নৃশংস হত্যার পূর্ণাঙ্গ বিচার দাবি জানাচ্ছি।’
তরুণ বয়সে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন সৈয়দ নজরুল। জাতীয় সব আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন তিনি। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে নিজের কাঁধে তুলে নেন মুক্তিযুদ্ধের সব দায়িত্ব। দেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধের। স্বাধীনতার পর শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে তার হাত ধরে কিশোরগঞ্জে গড়ে ওঠে বেশকিছু শিল্পকারখানা। এতে কর্মসংস্থান হয় এলাকার বহু মানুষের। এ অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে এলাকাবাসী। তবে সেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আজ আর চালু নেই। একে একে বন্ধ হয়ে গেছে সব।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতার যে বিচারটি হয়েছে, আমি মনে করি সেটি অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।’ চার নেতার মূল হত্যাকারীর পেছনে আরও যারা রয়েছে, তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে তদন্তের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ বিচারের দাবি করেছেন তিনি।
পিতার এমন কষ্টের মৃত্যুর কথা মনে হলে আজও শিউরে ওঠেন সৈয়দ নজরুল ইসলামকন্যা কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি। তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানের সঙ্গে হত্যা করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকেও। প্রিয় পিতাকে এভাবে হারাতে হবে ভাবিনি কখনও।’
তিনি আরও বলেন, ‘খুনি মোস্তাক জাতীয় চার নেতার সঙ্গে সমঝোতা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সেটি করেননি। তাদেরকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। কিন্তু আমার পিতাসহ কেউই মোস্তাকের ফাঁদে পা দেননি। এই চার নেতা তাদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও দেশের সঙ্গে বেইমানি করেননি। আমি জাতীয় চার নেতার এমন নির্মম-নৃশংস জেলহত্যার পূর্ণাঙ্গ বিচার দাবি করছি।’
প্রতিবছর ৩ নভেম্বর আসলেই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। কিন্তু জেলের ভেতর এমন নির্মম ও বর্বর হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা রয়েছেন তাদের তদন্ত সাপেক্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ বিচারের দাবি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্বজন ও জেলাবাসীর।