ডাল, মসলা, তেলবীজ, ভুট্টা—আমদানিনির্ভর এসব শস্য উৎপাদনে কৃষকদের জন্য রেয়াতি সুদে ঋণ কর্মসূচি চালু হয় প্রায় দুই দশক আগে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চালু করা বিশেষ এ ঋণ কর্মসূচি সাফল্যও পেয়েছে বিপুল। যদিও সাফল্যের মাত্রা অনুযায়ী পরিসর ও অবয়ব বড় হয়নি কৃষকদের জন্য চালু করা রেয়াতি সুদের এ বিশেষ প্রকল্প। এখন পর্যন্ত ৪ শতাংশ সুদের এ ঋণ কর্মসূচির আকার দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০৭ কোটি টাকায়, যা প্রতি বছর দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত কৃষি ঋণের দশমিক ৪৭ শতাংশেরও কম।
দেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের গুরুত্ব, কৃষির ব্যাপ্তি ও কৃষকদের চাহিদার তুলনায় বিশেষ এ তহবিলের আকার খুবই কম বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। রেয়াতি সুদে বিতরণকৃত ঋণের প্রভাব নিয়ে করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০-১১ অর্থবছরে কৃষি খাতে বিতরণকৃত ঋণের শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ ছিল রেয়াতি সুদে বিতরণকৃত ঋণ। সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে বিশেষ এ তহবিলের আওতায় বিতরণকৃত ঋণের অনুপাত না বেড়ে উল্টো কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে কৃষি খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে রেয়াতি সুদে বিতরণকৃত ঋণের অনুপাত শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে তা কোনো বছরই অর্জিত হচ্ছে না।
অথচ রেয়াতি সুদে বিতরণকৃত ঋণ আদায়ের হার ৯৩ শতাংশ। কেবল ৭ শতাংশ কৃষক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না বলে গবেষণাপত্রে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, রেয়াতি সুদে নেয়া ঋণের অর্থ কৃষকরা শস্য উৎপাদনে ব্যয় করছেন। পরবর্তী সময়ে উৎপাদিত শস্য বিক্রি করে যে মুনাফা হচ্ছে, সেটি থেকেই ঋণের অর্থ পরিশোধ করছেন কৃষকরা। যদিও গবেষক দলের কাছে ৭৪ শতাংশ কৃষকই বলেছেন, বিশেষ এ তহবিল থেকে যে পরিমাণ ঋণ তাদের দেয়া হয়, সেটি শস্য উৎপাদনে যথেষ্ট নয়। রেয়াতি সুদে ঋণ নেয়া ৭৯ শতাংশ কৃষক শস্য উৎপাদন থেকে যে মুনাফা করেন, সেটি দিয়ে জমিসহ অন্যান্য সম্পদ কিনতে পেরেছেন। একই সঙ্গে তারা পরিবারসহ অপেক্ষাকৃত ভালো জীবন যাপন করতে পারছেন। ভালো খাদ্যের পাশাপাশি মানসম্পন্ন পোশাক পরা থেকে শুরু করে সন্তানদের স্কুলে পড়াচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গভর্নর সচিবালয়ের মহাব্যবস্থাপক রোকেয়া খাতুন গবেষণায় সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। ‘অ্যান ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট স্টাডি অন স্পেশাল এগ্রিকালচারাল ক্রেডিট প্রোগ্রাম অ্যাট ফোর পারসেন্ট কনসেশনাল ইন্টারেস্ট রেট’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। রেয়াতি সুদে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণকারী ১০টি ব্যাংকের ৫৬টি শাখা এবং ঋণগ্রহীতা ৫৩৫ জন কৃষকের ওপর জরিপ চালিয়ে গবেষণাপত্রটি তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ এ তহবিলের সাফল্য ও প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরার পাশাপাশি ১০টি সুপারিশ করা হয়।
গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে গভর্নর সচিবালয়ের মহাব্যবস্থাপক রোকেয়া খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, রেয়াতি সুদে কৃষকদের ঋণ বিতরণের কর্মসূচিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সফল প্রকল্প। বিশেষ তহবিল থেকে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকরা আমদানিনির্ভর শস্য উৎপাদন করছেন। এতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে শস্য আমদানি কমেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তহবিলটির আকার ও ব্যাপ্তি প্রত্যাশা অনুযায়ী বড় হয়নি। আমরা কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে বাস্তব যে পরিস্থিতি দেখেছি, সেটিই গবেষণাপত্রে তুলে ধরেছি। আশা করছি, এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকরা উদ্যোগী হবেন।
২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো রেয়াতি সুদে আমদানিনির্ভর শস্য উৎপাদনে কৃষিঋণ বিতরণের তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় এ তহবিলের আকার ছিল ২০ কোটি টাকা আর সুদহার ২ শতাংশ। শুরুতে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো এ ঋণ বিতরণ করত। কিন্তু ২০১২ সালে নীতিমালাটি সংশোধন করে দেশের সব ব্যাংককে রেয়াতি সুদের এ ঋণ বিতরণের নির্দেশনা দেয়া হয়। একই সময়ে সুদহার বাড়িয়ে করা হয় ৪ শতাংশ। ওই সময় বিশেষ এ ঋণ প্রকল্পের আকার দাঁড়ায় ৭১ কোটি টাকায়। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে ৪ শতাংশ সুদের এ ঋণের তহবিলের পরিমাণ ১০৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
বর্তমানে ৪ শতাংশ সুদের ঋণ যে শস্যগুলোর উৎপাদনে দেয়া হয় সেগুলো হলো ডালজাত শস্য যেমন: মুগ, মসুর, খেসারি, ছোলা, মটর, মাষকলাই, তৈলবীজজাত শস্য যেমন: সরিষা, তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী ও সয়াবিন, মসলাজাত শস্য যেমন: আদা, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, হলুদ, জিরা। এছাড়া ভুট্টাকেও রেয়াতি সুদের ঋণের আওতায় আনা হয়েছে।
রেয়াতি সুদের তহবিলটির সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে গবেষণাপত্রে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, আমদানিনির্ভর কৃষিশস্যের উৎপাদন বাড়াতে হলে বিশেষ কৃষিঋণ কর্মসূচির আওতা বাড়ানো দরকার। বিশেষ এ প্রকল্পের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগী হতে হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ ছিল রেয়াতি সুদের। এক্ষেত্রে মোট কৃষি ঋণের অন্তত ১-২ শতাংশ রেয়াতি সুদের ঋণ বিতরণ করার জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে মোট ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে গবেষক দল দেখছে, রেয়াতি সুদে প্রতিজন কৃষককে যে পরিমাণ ঋণ দেয়া হয়, সেটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এজন্য কৃষকরা যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী আরো বেশি রেয়াতি সুদের ঋণ নিতে পারেন, সে বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। একই সঙ্গে ঋণ পরিশোধের সময়সীমার বিষয়েও নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছেন গবেষকরা। তাদের সুপারিশ হলো নীতিমালাটি এমন হওয়া দরকার, যাতে কৃষকরা ফসল তোলার মৌসুমে সেটি কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য না হন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার কৃষি খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে শস্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি বাণিজ্যিকীকরণ করতে চায়। চলমান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর অর্থনীতিতে কৃষি খাতের গুরুত্ব আরো বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। এ অবস্থায় রেয়াতি সুদের আওতা প্রসারিত করার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কলা, লিচু, মাল্টা, পেঁপে, আনারস, পেয়ারা, বরই, ড্রাগন ফল, কমলাসহ আমদানিনির্ভর ফলগুলোর উৎপাদনে রেয়াতি সুদে ঋণ দেয়া যেতে পারে বলে মনে করছে গবেষক দল।
করোনাকালে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে কৃষি খাতের জন্য ৪ শতাংশ সুদে কৃষি ঋণ বিতরণের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। গবেষক দল মনে করছে, স্বল্প সুদের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর ফসল উৎপাদনকে প্রাধান্য দেয়া দরকার। অন্যথায় কৃষকরা ডাল, মসলা, তেলবীজ, ভুট্টার মতো আমদানিনির্ভর শস্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এসব শস্য উৎপাদনের জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহার ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ বা ৩ শতাংশ নির্ধারণের জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। সুদের হার ২ বা ৩ শতাংশ কমালে সরকারের ভর্তুকি হিসেবে অতিরিক্ত ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে।
রেয়াতি সুদের ঋণ যাতে অকৃষি খাতে ব্যয় না হয় সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তদারকি জোরদার করতে বলেছে গবেষক দল। একই সঙ্গে এ ঋণের ব্যাপ্তি বাড়াতে এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট বা উপশাখার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিতে সুপারিশ করা হয়েছে। গবেষক দল মনে করে, পণ্যের মূল্য সুরক্ষার একটি নীতি থাকা দরকার, যাতে কোনো পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক না বাড়ে। বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়ে কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থহানি যেন না হয়।
রেয়াতি সুদের তহবিলটি ৩-৪ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা দরকার বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া। বর্তমানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এ ব্যাংকার বণিক বার্তাকে বলেন, রেয়াতি সুদের তহবিলটির পরিমাণ ও ব্যাপ্তি বাড়ানো হলে দেশের কৃষকদের পাশাপাশি রাষ্ট্র উপকৃত হবে। গত কয়েক বছরে দেশে ভুট্টা উৎপাদনে বিপ্লব এসেছে। তেল ও ডালজাত শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি আমদানি বেশি হয় এমন শস্য উৎপাদনে এ তহবিল থেকে আরো সহজ শর্তে ঋণ দেয়া দরকার। একই সঙ্গে তহবিলটির সুদহার কমানো হলে কৃষকরা শস্যগুলো উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ হবেন বলে মনে করেন তিনি।
তথ্য সূত্র : https://bonikbarta.net/