‘কপোতাক্ষ নদের ঢেউ থেকে রক্ষায় ঘূর্ণিঝড় আইলার পর সামাজিক বন বিভাগ গাছগুলো রোপণ করেছিল। প্রায় ১৪ বছর ধরে স্থানীয় লোকজন এসব দেখাশোনা করছেন। প্রতিটি গাছ বড় হয়েছে। সেখানে পাখপাখালি আশ্রয় নিয়েছে। হঠাৎ গাছ কাটতে দেখে অবাক হয়েছি।’ কথাগুলো বললেন খুলনার কয়রার হরিহরপুরের বাসিন্দা কৃষ্ণা মণ্ডল। সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানালেন।
কেবল কৃষ্ণা মণ্ডলই নন, কয়রার আপামর জনতা কেউই রক্ষা বাঁধ নির্মাণে সামাজিক বনায়নের ক্ষতি মানতে পারছেন না। বেড়িবাঁধ চাইলেও গাছ কাটাতে নারাজ তারা।
কয়রা উপজেলা উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘বেড়িবাঁধ দরকার, চর বনায়নের গাছও দরকার। এ ছাড়া সংস্কার করা বাঁধ টিকিয়ে রাখতেও গাছের প্রয়োজন। কিন্তু যে গাছ কাটা হয়েছে, এগুলো আগামী ২০ বছরেও লাগানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। রক্ষা বাঁধের ঢালস্বরূপ চরের গাছ না কেটে বাঁধ নির্মাণ করুন।’
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কয়রার কপোতাক্ষ নদ-তীরবর্তী বাঁধ কাজের জন্য চরের সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে হরিহরপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। শুরুতে স্থানীয় লোকজনের প্রতিরোধ ও সামাজিক বন বিভাগের বাধার মুখে ঠিকাদারের লোকজন গাছ কাটা বন্ধ করে রাখেন। তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ, সম্প্রতি গোপনে আবারও গাছ কাটা চলছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাতক্ষীরা-২ বিভাগের অধীনে কয়রার ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে দুটি প্যাকেজে প্রায় ৮ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। পাউবো জানায়, প্রায় ২৬ কোটি টাকা মূল্যে এটি বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আমিন অ্যান্ড কোং। ১৫ ডিসেম্বর থেকে তারা কাজ শুরু করে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আমিন অ্যান্ড কোংয়ের পক্ষে হরিহরপুরের কাজ তত্ত্বাবধানকারী রাসেল হোসেন বলেন, ‘কাজের স্বার্থে কিছু গাছ কাটতে হচ্ছে।’
জানা গেছে, বাঁধের উভয় পাশে কয়েকটি এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। কপোতাক্ষ নদের চর থেকে মাটি কাটার সময় এসব যন্ত্র দিয়ে উপড়ে ফেলা হচ্ছে গাছ। এসব গাছ মাটিচাপাও দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া নদের চর দিয়ে এক্সকাভেটর নিয়ে যাওয়ার জন্য বালু ভরাট করে পথ তৈরি করা হচ্ছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, এতেও অসংখ্য গাছ কাটা পড়বে।
এলাকাবাসী জানান, বাঁধ রক্ষায় ঢাল হিসেবে কাজ করে চর বনায়নের গাছ। এ ছাড়া এখানে পাখিদের অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাঁধের কাজ শুরু হলে শত শত গাছ কাটতে শুরু করেন শ্রমিকরা। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন গাছের ক্ষতি করতে নিষেধ করেন। সেখান থেকে কাটা গাছের গুঁড়ি জব্দ করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে রাখা হয়। এরপরও ঠিকাদারের লোকজন গাছ কাটা থামাননি।
হরিহরপুর গ্রামের কবিতা রানী মণ্ডল বলেন, ‘ঝড়-বন্যার সময় দেখিছি অন্য এলাকার বাঁধ ভেঙে গেলেও আমাদের এখানকার বাঁধের কোনও ক্ষতি হয় না। ঝড়ের সময় চরের বড় গাছগুলো ঢাল হিসেবে আমাদের রক্ষা করে। গাছগুলো এভাবে কাটা ঠিক হলো না।’
স্থানীয় বাসিন্দা ফকির চাঁদ বলেন, ‘আগে বাঁধ মেরামতে শ্রমিকরা ঝুড়ি-কোদাল দিয়ে কাজ করতো। দূর থেকে মাথায় করে মাটি আনতো। এখন যন্ত্রের সাহায্যে বাঁধের ঢাল থেকে মাটি কাটায় বাঁধ ঝুঁকিতে পড়বে।’
উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) হরষিত কুমার মণ্ডল বলেন, ‘মাসখানেক আগে গ্রামের লোকজন খবর পায় বড় বাঁধ নির্মাণের জন্য চরের সব গাছ কেটে ফেলা হবে। এ সংবাদে গ্রামের অনেকে গাছ কাটা শুরু করে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সামাজিক বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন গাছ কাটা বন্ধ করে। ঠিকাদারের লোকজনকেও গাছ না কাটতে নির্দেশনা দেয়। গ্রামবাসী থেমে গেলেও ঠিকাদারের লোকজন গাছ কাটা চালিয়ে যাচ্ছে।’
সাতক্ষীরা-২ পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মেহেদী হাসান মিশুক বলেন, ‘বাঁধটি বেশি চওড়া হওয়ায় এক্সকাভেটর চালানোর জন্য বালু ভরাট করে পথ তৈরি করতে হচ্ছে। যে কারণে গাছগুলো কাটা পড়েছে। এ ব্যাপারে আমরা বন বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। নির্মাণ শেষে আবারও চর বনায়ন করা হবে।’
সামাজিক বন বিভাগের কয়রা উপজেলার দায়িত্বরত কর্মকর্তা শফিউর রহমান সবুজ বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণ শেষে ফের চর বনায়ন করে আবারও ১৪ বছর পিছিয়ে পড়তে হবে। এই গাছগুলোই এলাকার বাঁধ রক্ষা করেছে। তাই আমরা গাছ কাটা বন্ধ করতে বলেছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও জানিয়েছি।’