বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ, বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, সনেট রচয়িতা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ২০১তম জন্মবার্ষিকী আগামীকাল ২৫ জানুয়ারি। এ উপলক্ষে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) বিকালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো সপ্তাহব্যাপী মধুমেলা।
মহাকবির জন্মস্থান সাগরদাঁড়ীতে ফুলের ফিতা কেটে, কবুতর ও বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকার। এরপর তিনি ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান স্মরণে তৈরি জুলাই বিপ্লব কর্নার, কৃষি অধিদফতরের স্টলসহ কয়েকটি স্টল ঘুরে দেখেন।
সাত দিনব্যাপী মধুমেলা উদ্বোধন করার কথা ছিল সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর। কিন্তু রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে তিনি পূর্বনির্ধারিত আজকের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারছেন না বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এদিকে, মেলা উপলক্ষে মধুকবির জন্মভূমির স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদ, জমিদারবাড়ির আম্রকানন, বুড়ো কাঠবাদাম গাছতলা, বিদায় ঘাটসহ মধুপল্লী সেজেছে অপরূপ সাজে।
এবারের মেলায় রয়েছে কুটিরশিল্প, গ্রামীণ পসরা, লোকজ সংস্কৃতি যাত্রাপালা, সার্কাস, জাদু প্রদর্শনী এবং শিশুদের বিনোদনমূলক নানা আয়োজন। প্রতিদিন সাগরদাঁড়ীর মধুমঞ্চে আলোচনার পাশাপাশি নাটক, কবিতা আবৃত্তিসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।
আয়োজকরা জানান, মেলায় ১৫০টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুই শতাধিক ছোটবড় স্টলে রয়েছে বিভিন্ন কারুপণ্য ও খাবারের দোকান। মেলা চলবে আগামী ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় মধুমেলা আয়োজন করেছে যশোর জেলা প্রশাসন।
যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম বলেছেন, দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের জন্য সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে মধুমেলা উপভোগের লক্ষ্যে প্রশাসন তৎপর। মেলার সর্বত্র সিসিটিভি বসানো হয়েছে। নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে পুলিশ, আনসার, র্যাব, বিজিবি।
এবারের মেলা হবে পরিচ্ছন্ন, আগের মতো কোনও অসামাজিক কর্মকাণ্ড এই মেলায় চলবে না।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন– যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম, যশোর সরকারি এমএম কলেজের অধ্যক্ষ ড. খন্দোকার এহসানুল কবির, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী, কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাকির হোসেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমীন, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আবুল হোসেন আজাদ, জামায়াতের জেলা আমির অধ্যক্ষ গোলাম রসুল, প্রেসক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, যশোর ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ডা. আবুল কালাম আজাদ, লেখক গবেষক বেনজীন খান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা সদস্যসচিব জেসিনা মুর্শিদ প্রাপ্তি প্রমুখ।
মহকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কালজয়ী এ সাহিত্যিকের লেখনীতে ফুটে উঠেছে বাঙালির স্বাধীনচেতা মনোভাব। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি সাগরদাঁড়ী গ্রামে জমিদার বাবা রাজনারায়ণ দত্ত ও মা জাহ্নবী দেবীর কোল আলোকিত করে তিনি জন্ম নেন।
শৈশবে সাগরদাঁড়ীর পাশে শেখপুরা গ্রামের মৌলভী খন্দকার মখমল সাহেবের কাছে বাংলা ও ফারসি শিক্ষা লাভ করেন কবি। ১৮৩৩ সালে সাগরদাঁড়ী ছেড়ে কলকাতার খিদিরপুর যান। সেখানে লালবাজার গ্রামার স্কুলে ইংরেজি, ল্যাটিন ও হিব্রু ভাষা শিক্ষা নেন।
কবি ১৮৩৭ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। ১৮৪২ সালে ইংরেজিতে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ‘স্ত্রীশিক্ষা’ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে কলেজ থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৮৫২ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইস্কুল বিভাগে শিক্ষকতার চাকরি নেন। ১৮৫৪ সালে দৈনিক স্পেকটেটর পত্রিকায় সহ-সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ওই বছরই বের হয় পুস্তিকা ‘দ্য অ্যাংলো সেক্সন অ্যান্ড দ্য হিন্দু’। ১৮৫৭ সালে আদালতে দোভাষী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৮৫৮ সালে ‘শর্মিষ্ঠা নাটক’ লিখে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন ও নাট্যান্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
১৮৬০ সালে ‘পদ্মাবতী নাটক’ প্রকাশ হয়। এরপর ভাষায় প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ প্রকাশ হয়। ১৮৬১ সালে জানুয়ারিতে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে ব্যারিস্টারিতে ভর্তি হন।
১৮৬৩ সালে অর্থকষ্টে পড়েন। এ অবস্থায় পরিবারসহ প্যারিসের ভার্সাই নগরীতে চলে যান। ১৮৬৭ সালে ছেলেমেয়েকে ফ্রান্সে রেখে কলকাতায় চলে যান। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন মারা যান এই মহাকবি।
১৯৭৩ সাল থেকে সাগরদাঁড়ীতে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।