টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ভারত সীমান্তবর্তী শেরপুরের তিন উপজেলা। এতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে ডুবে মৃত্যু হয়েছে চার জনের। নিখোঁজ আছেন একজন।
মৃতরা হলেন নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী ইউনিয়নের অভয়পুর গ্রামের বছির উদ্দীনের দুই ছেলে আবু হাতেম (৩০) ও আলমগীর (১৭), বাঘবেড় ইউনিয়নের বাঘবেড় গ্রামের মানিক মিয়ার স্ত্রী ওমিজা খাতুন (৪৫) এবং নয়াবিল ইউনিয়নের আন্ধারুপাড়া গ্রামের ইদ্রিস মিয়া (৮০)। এর মধ্যে শনিবার রাতে দুই ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আগের দিন শুক্রবার দুপুরের পর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চেল্লাখালী নদীর পানির স্রোতে ভেসে যান তারা। একই সময় সেখানকার বাতকুচি গ্রামের জহুরা খাতুন (৪৫) ভেসে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন। একই দিন গ্রামের ডুবন্ত সড়ক পার হওয়ার সময় ভেসে গিয়ে ইদ্রিস মিয়ার এবং বন্যার পানিতে ডুবে ওমিজা খাতুনের মৃত্যু হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যায় নিম্নাঞ্চলে পানি বেড়েই চলেছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এতে বাড়ছে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা। ডুবে গেছে দুই শতাধিক গ্রাম। তলিয়ে আছে রাস্তাঘাট। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। দেখা দিয়েছে খাবার সংকট। দুর্গম গ্রামীণ এলাকায় নৌকা ছাড়া যোগাযোগ না করতে পারায় সেখানে কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি।
বন্যায় ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, সবজির খেত, কাঁচা পাকা ঘরবাড়ি, গাছগাছালি, গবাদি পশু, বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েকটি সড়কসহ অসংখ্য গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক। কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক এলাকা। সংকট তৈরি হয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির এবং গোখাদ্যের। জেলা প্রশাসন থেকে শুকনো খাবার এবং উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে।
এরই মধ্যে বন্যায় মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। পানিতে তলিয়ে যায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান। এতে ঝিনাইগাতি উপজেলা পরিষদ ও সদর বাজারসহ অন্তত ৭টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি ইউনিয়নগুলো ছাড়াও নদী তীরবর্তী অন্যান্য ইউনিয়ন ও নিম্নাঞ্চলের ইউনিয়নগুলো প্লাবিত হয়ে পড়ে। শুক্রবার রাত থেকে পাহাড়ি নদীগুলোতে পানির তীব্রতা কিছুটা কমে এলেও শনিবার ভাটি অঞ্চলের নতুন এলাকা প্লাবিত হতে শুরু করে। সব মিলিয়ে অন্তত ১২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয় এই উপজেলার।
বানভাসি মানুষকে উদ্ধারে শুক্রবার থেকেই কাজ করছে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। শনিবার দিনভর স্পিডবোট, নৌকা, ভেলা, টিউব ইত্যাদি নিয়ে চলে বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধার অভিযান। এ ছাড়া শুকনো খাবারসহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে বানভাসিদের মাঝে। এসব কাজের অংশ নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা বিএনপিসহ বিভিন্ন সংগঠন।
শনিবার বিকাল পর্যন্ত নিম্নাঞ্চলের মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে দেখা গেছে। কেউ আত্মীয় বাড়ি,পাকা রাস্তা, আবার কেউ বা ছুটেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।
শেরপুর জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, শেরপুরের বন্যা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে বন্যার্তদের শুকনো খাবার ও গো খাদ্যের ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে। এ জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
তবে বন্যা পরিস্থিতি একদিনের মধ্যে উন্নতি হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সজল কুমার রায় বলেন, শেরপুরে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকলেও ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর পানি আরও কমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। দুটি নদী ছাড়া দেশের সব নদনদীর পানি বর্তমানে বিপদসীমার নিচে রয়েছে।
এদিকে আশ্বিনের শেষভাগে এসে যে বৃষ্টিস্নাত দিন দেখছে বাংলাদেশ, তা আরও সপ্তাহখানেক চলতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দেশের সব সমুদ্রবন্দরে স্থানীয় ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত ঘোষণা করায় ঢাকা থেকে উপকূলীয় তিন জেলার ছয় রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
পানিসম্পদ সচিব নাজমুল আহসান জানান, শেরপুরে বৃহস্পতিবার রাতে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়। সেই সঙ্গে উজানের প্রবল পাহাড়ি ঢলে ঝিনাইগাতীর মহারশি নদীর বাঁধের চারটি স্থানে ও নালিতাবাড়ীর চিল্লাখালী নদীর বাঁধের দুটি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি
শেরপুরের তিন উপজেলায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন আবাদ, মাছের ঘের ও সবজি। ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ীর মহারশি ও ভোগাই নদীর অন্তত ১০ জায়গায় বাঁধ ভেঙে ও পাড় উপচে প্লাবিত গ্রামের বিভিন্ন রাস্তাঘাট ও ফসল তলিয়ে গেছে। অনেক স্থানে ধসে ও ভেসে গেছে ঘরবাড়ি। পানি উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে।
স্থানীয়রা জানান, এসব এলাকায় কিছু আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। তারা বলছেন, গত ৩৬ বছরে এমন বন্যা দেখেননি। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অনেকে বিপাকে পড়েছেন। প্রধান সড়কের আশপাশে সহযোগিতা পেলেও প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে পৌঁছায়নি ত্রাণ সহায়তা। সেখানে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট।
শেরপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিরুল ইসলাম বলেন, অনেক সড়কই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেগুলো আপদকালীন সময়ে মেরামতযোগ্য সেগুলো কাজ করা হচ্ছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ রানা বলেন, পাহাড়ি ঢলে ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে আটটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৩৫ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। প্রায় সাত হাজার মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভার তরফ থেকে পাঁচটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় পাঁচ হাজার পরিবারের মধ্যে শুকনা খাবারের প্যাকেট ও খাওয়ার পানি দেওয়া হয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার অন্তত ২০ হাজার হেক্টর আমন এবং দেড় হাজার হেক্টর সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রণব কুমার কর্মকার বলেন, ঝিনাইগাতী সদর, নলকুড়া, গৌরীপুর, নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল, রামচন্দ্রকুড়া এবং নালিতাবাড়ী সদর ইউনিয়নের সব খামারের মাছ ভেসে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাকিবুজ্জামান খান জানান, শনিবার বিকালে ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ভোগাই, চেল্লাখালী ও ঝিনাইগাতীর মহারশি নদীর বেশ কয়েকটি স্থানে দুই পাড় ও তীর রক্ষার বাঁধ ভেঙে গেছে। সেখানে জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন ঠোকানোর চেষ্টা চলছে।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান জানান, দুর্গতদের উদ্ধারে ও তাদের কাছে শুকনো খাবার পৌঁছে দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ চলছে।