রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের স্বপ্ন একদিন দেশে ফিরবে, খেলবে বিদেশের মাঠে
বাংলাদেশ

রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের স্বপ্ন একদিন দেশে ফিরবে, খেলবে বিদেশের মাঠে

মিয়ানমারের জাতীয় খেলা চিনলোন। প্রায় প্রতিদিনই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এই খেলার আসর জমে। দর্শক আর খেলোয়াড় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত শিশু-কিশোররা। পাশাপাশি আরাকানের জনপ্রিয় খেলা ফুটবলও খেলছে তারা। বাংলাদেশে বসবাস করলেও নিজ দেশের খেলাগুলোর চর্চা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে এসব শিশু-কিশোর। চিনলোন আর ফুটবল তাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। এই খেলাধুলার মধ্য দিয়ে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত শিশু-কিশোরদের দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে। তাদের স্বপ্ন, একদিন ফিরে যাবে নিজ দেশে, নিজের জন্মভূমিতে হবে বসতি, সেখানে তৈরি হবে সুন্দর খেলার মাঠ। খেলবে চিনলোন আর ফুটবল। পরিপক্ব হয়ে দেশ-বিদেশের মাঠে খেলে একদিন দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনবে। নতুন ভবিষ্যতের এমন স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করে দিন কাটায় তারা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কুতুপালংয়ের প্রধান সড়ক থেকে পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি ফাঁকা মাঠে চিনলোনের অনুশীলন করছে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোররা। মাঠের চারদিকে নিজেদের থাকার ঘর। তখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তবে থামেনি তাদের খেলা। ছোট মাঠের দুই পাশে লম্বা খুঁটি গেড়ে মাঝখানে জাল টাঙিয়ে চিনলোন খেলছে তারা। জালের একপাশে একদল, অপরপাশে আরেকদল। একে-অপরের দিকে পা দিয়ে ছুড়ছে বল। বল মাটিতে পড়লেই পয়েন্ট যোগ হয়। দেখতে অনেকটা ভলিবলের মতো এই খেলা। তাদের খেলা দেখে আনন্দে হাততালি দিচ্ছে দর্শক শিশু-কিশোররা। 

এই মাঠের আরেক পাশে ফুটবল এবং ভলিবল খেলতে দেখা গেলো আরেকদল শিশু-কিশোরদের। এ সময় মাঠে ফুটবল খেলার নানা কৌশল দেখাচ্ছিল নিজেকে লিওনেল মেসি দাবি করা ১৭ বছর বয়সী মো. ওমর ফারুক। তার প্রিয় খেলোয়াড় মেসি। বল নিয়ে মাঠে জাদু দেখাতে পারে বলে ক্যাম্পের শিশু-কিশোররা তাকে মেসি বলেই ডাকে। এমন ডাক শুনতে ভালো লাগে ওমর ফারুকের।

এই কিশোরের ভাষ্য, ‘আমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষে প্রতিদিন এখানে খেলতে আসি। কিন্তু খেলার মাঠের অবস্থা ভালো নয়। এই মাঠ ছাড়া আমাদের বিকল্পও নেই। ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার সুযোগ হয় না। তাই অন্য মাঠে খেলার সুযোগ নেই। এখানে প্রতিদিন শতাধিক শিশু-কিশোর খেলাধুলা করে। এটি আমাদের আনন্দ-উৎসবের জায়গা। আমি ফুটবল খেলতে পছন্দ করি। মেসি আমার প্রিয় খেলোয়াড়।’

ওমর ফারুক জানায়, স্বপ্ন দেখি একদিন নিজ দেশের মাটিতে বড় টুর্নামেন্টে খেলবো, মাঠভর্তি দর্শক থাকবে, সবাই খেলা দেখে হাততালি দেবে। সেখান থেকে বিদেশের মাঠে খেলবো। দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনবো। এই স্বপ্ন বুকে লালন করে খেলাধুলা চালিয়ে যাচ্ছি। খেলাধুলার জন্য এখানে আমাদের বড় মাঠ দরকার। জুতা ও জার্সি দরকার। এসব সামগ্রী পেলে আমরা আরও উৎসাহী হতাম। এখানে আছি অসহায়ের মতো। দেশ নেই, মাঠ নেই, ঘরের ঠিকানা নেই। তার ওপর খেলাধুলার সামগ্রী চাইবো কার কাছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিশু-কিশোরদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে ক্যাম্পের শিশু-কিশোররা মিলে লম্বাশিয়ার এই মাঠ খেলাধুলার জন্য উপযোগী করে তোলে। এরপর কয়েকজন ফুটবলপ্রেমী কিশোর মিলে ‘কুতুপালং ডি-১ ফুটবল ক্লাব’ নামে একটি সংগঠন গড়ে। তখন থেকে এই মাঠে চিনলোন, ফুটবল ও ভলিবলের ছোট-বড় টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালে ফিফা বিশ্বকাপের আসরের সময়ে বড় টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়েছিল। সেসময় ২৬টি ফুটবল দল খেলায় অংশ নেয়। যার ফলে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের মাঝে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।

খেলাধুলার মধ্য দিয়ে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত শিশু-কিশোরদের দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে

এই মাঠে নিয়মিত খেলাধুলা করে কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর হাকিম (১৫)। তার ভাষ্য, বৃহস্পতিবার-শুক্রবার এই মাঠে জমজমাট খেলা হয়। আমার ফুটবল খেলা প্রিয়। রাখাইনে থাকাকালে আমি স্কুলের পক্ষ থেকে চিনলোন খেলায় অংশ নিয়েছিলাম। তখন বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবলও খেলেছি। এখন এসব মনে পড়লে খারাপ লাগে। নিজের দেশে ফিরতে চাই, সেখানে ফিরে আবারও খেলতে চাই, পড়তে চাই। এখানে ঘনবসতি। সবার খেলার সুযোগ হয় না। সব ক্যাম্পে মাঠ নেই। শিশু-কিশোরদের সবসময় ঘরে বসে থাকতে হয়। তখন দেশের কথা মনে হয়। খেলাধুলা করলে মনে আনন্দ লাগে। কিছুটা হলেও কষ্ট ভুলে থাকা যায়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফুটবলের কারিগর হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ রফিক (৩৬)। তিনি কুতুপালং ফুটবল ক্লাবের টিম লিডার। তার হাত ধরে ওই মাঠ আর শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা শুরু হয়। মো. রফিক বলেন, ‘ক্যাম্পে ঘনবসতি। দিনভর ঘরে থাকা এক ধরনের যন্ত্রণা। বের হলে রাস্তার নোংরা ড্রেনে শিশুদের খেলাধুলা করতে হয়। বিশেষ করে কিশোরদের একটি অংশ মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এগুলো দেখে মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলাম। নিজেরাই মাঠটি সংস্কার করে খেলার উপযোগী করেছি। আনন্দের বিষয় সফলও হয়েছি। কারণ এখন এই মাঠে শত শত শিশু-কিশোর খেলছে আনন্দের সঙ্গে। তবে এটা সত্য যে কয়েকটি ক্যাম্প ছাড়া বাকি ক্যাম্পগুলোতে খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে না শিশু-কিশোররা।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্লাবে ৫-১০ বছরের শিশুদের ১০টি ও ১৮-৩৫ বছরের ২৬টি ফুটবল দল রয়েছে। এছাড়া ১০টি চিনলোন এবং ১২টি ভলিবলের দল রয়েছে। আমাদের দলগুলোর অনেক খেলোয়াড় নাইক্ষ্যংছড়ি-কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় অর্থের বিনিময়ে অতিথি খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে যায়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নুর হাসান, নুর মোস্তাফা, মো. কায়সার, আরফাত, মো. রফিক ও সাদেক।’

নিজেকে লিওনেল মেসি দাবি করা ১৭ বছর বয়সী মো. ওমর ফারুক

মাঠের পাশে চায়ের দোকানে বসে শিশু-কিশোরদের খেলা দেখছিলেন লম্বাশিয়া ক্যাম্পে বসবাসকারী তোফায়েল মিয়া (৫৩)। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে এই মাঠে খেলাধুলা করে। তার খেলা দেখতে এসেছি। কারণ তাকে নিয়ে গত কয়েক মাস অনেক কষ্ট করেছি। কিছু ছেলের সঙ্গে মিশে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। অনেক চেষ্টার পরও মাদক ছাড়ছিল না। বিষয়টি ফুটবল দলের টিম লিডারকে জানাই। পরে তার সহযোগিতায় ছেলেকে মাদকমুক্ত করতে পেরেছি। এর পেছনে ফুটবল খেলার বিনোদন ছিল অন্যতম।’

তোফায়েল মিয়ার ছেলের মতো আরও অনেক শিশু-কিশোর খেলাধুলায় মেতে থাকায় মাদক থেকে দূরে আছে বলে জানালেন একই ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুল আমিন। তিনি বলেন, ‘মাঠ না থাকলে অনেক শিশু-কিশোর মাদক ও অপরাধে জড়িয়ে পড়তো। খেলাধুলায় বেশিরভাগ সময় কেটে যাওয়ায় ওরা মাদক থেকে দূরে আছে। ফলে অন্য ক্যাম্পের তুলনায় এই ক্যাম্পে মাদক বিক্রি এবং অপরাধ অনেক কম।’

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবাইর বলেন, ‘বিশেষ করে ক্যাম্পে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। যে কয়েকটি মাঠ আছে, সেগুলোর অবস্থাও খারাপ। আসলে এমন এক পরিবেশে আমরা জীবনযাপন করছি, সেখানে শিশু-কিশোরদের বেড়ে উঠার জন্য আলাদা পরিবেশের কথা ভাবাই অবাস্তব। তবু ক্যাম্পগুলোতে কিছু খেলাধুলার মাঠের ব্যবস্থা করা গেলে মাদকসহ নানা অপরাধ থেকে দূরে থাকবে শিশু-কিশোররা।’

তিনি আরও বলেন, ‘লম্বাশিয়ায় খেলার মাঠ থাকায় সেখানকার শিশু-কিশোররা খেলাধুলায় আনন্দে সময় কাটায়। ফলে ওই ক্যাম্পের পরিবেশের পাশাপাশি অপরাধও কম। এজন্য বাকি ক্যাম্পগুলোতে খেলাধুলার মাঠ তৈরি করা উচিত। বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলো এগিয়ে এলে সবগুলো ক্যাম্পের পাশে মাঠ তৈরি করা সম্ভব। তখন মাদকসহ নানা অপরাধ থেকে বাঁচবে শিশু-কিশোর।’

আরাকানের জনপ্রিয় খেলা ফুটবলও খেলছে তারা

ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের জন্য ফুটবলসহ নানা খেলার আয়োজন করা হয় বলে জানালেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-১৪ (এপিবিএন)-এর অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. ইকবাল। তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ খেলাধুলার আয়োজনে আমরা সহযোগিতা করে থাকি। পাশাপাশি ক্যাম্পের পরিবেশ যাতে শান্ত থাকে, তা নিয়েও কাজ করি। মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধ থেকে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের দূরে রাখতে বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতি উৎসাহিত করা হয়।’ 

বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) যৌথ শুমারি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছে ৯ লাখ ২৬ হাজার ৪৮৬ জন। যার ৫২ শতাংশই শিশু। এর মধ্যে ০-১ বছর বয়সী শিশু ১৭ হাজার ১৮৬ জন, ১-৪ বছর বয়সী শিশু ১ লাখ ২৫ হাজার ৫২৮ জন, ৫-১১ বছর বয়সী শিশু ২ লাখ ৩ হাজার ৭২৭ জন এবং ১২-১৭ বছর বয়সী কিশোর ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯৯ জন। পরিসংখ্যান অনুসারে, ৫ লাখ ৭ হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গা শিশুর মধ্যে ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৪ জন মেয়েশিশু ও ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৯৬ জন ছেলেশিশু। এদের অধিকাংশই ক্যাম্পের জীবনে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বর্তমানে তারা উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

Source link

Related posts

রূপসা বাজারে ভয়াবহ আগুনে পুড়লো ২৬ ঘর

News Desk

স্কুল থেকে ফেরার পথে শিক্ষার্থী নিহত

News Desk

টাঙ্গাইল পুলিশ ফাঁড়িতে তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজনের হামলা

News Desk

Leave a Comment