রক্ষণাবেক্ষণের টাকাও তুলতে পারছে না টানেল, দিনে লস ২৫ লাখ টাকা
বাংলাদেশ

রক্ষণাবেক্ষণের টাকাও তুলতে পারছে না টানেল, দিনে লস ২৫ লাখ টাকা

প্রত্যাশা অনুযায়ী যানবাহন চলাচল করছে না ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দিয়ে। ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত রয়েছে। নির্মাণের আগে করা সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল, টানেল চালুর প্রথম বছরে দিনে গড়ে ১৭ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকে টানেল দিয়ে দৈনিক চার হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করছে।

বর্তমানে যে পরিমাণ যানবাহন টানেল দিয়ে চলাচল করছে তা থেকে দৈনিক টোল বাবদ আয় হয় ১২ লাখ টাকার মতো। টোল থেকে যে পরিমাণ অর্থ আদায় করা হয় তা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের তিন ভাগের এক ভাগ। টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণসহ আনুষঙ্গিক কাজে গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর মধ্যে একটি অংশ ব্যয় হয় টানেলে কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ ছাড়াও সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। অর্থাৎ টানেলে দিনে ক্ষতি হচ্ছে ২৫ লাখ টাকার মতো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টানেল ছিল একটি অপ্রয়োজনীয় উচ্চবিলাসী প্রকল্প। কর্ণফুলী নদীতে কালুরঘাট, রাঙ্গুনিয়া চন্দ্রঘোণাসহ বিভিন্ন স্থানে জনসাধারণের জন্য ব্রিজের প্রয়োজন ছিল। টানেল নির্মাণে ব্যয় হওয়া অর্থ দিয়ে দশটি ব্রিজ নির্মাণ করা যেত। কেউ কেউ টানেলকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের লুটপাটের প্রকল্প হিসেবেও দাবি করছেন।

টানেল প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন। ২৯ অক্টোবর থেকে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত হয়। প্রথম দিন পাঁচ হাজার ৬৭৮টি গাড়ি পার হয়। এতে টোল আদায় হয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ৩০০ টাকা।

টানেল টোল ম্যানেজার বেলায়েত হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উদ্বোধনের পর থেকে বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত টানেল দিয়ে যাতায়াত করেছে ১৩ লাখ ১৬ হাজার ২২৬টি গাড়ি। এসব গাড়ি বাবদ টোল আদায় হয়েছে ৩৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সবচেয়ে বেশি চলাচল করে প্রাইভেটকার। এরপর রয়েছে জিপ এবং মাইক্রো। এর মধ্যে বেশি হলো পর্যটকদের গাড়ি। গণপরিবহনের সংখ্যা অত্যন্ত কম।’

টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। তখন ২০১৭ সালকে টানেল চালুর বছর ধরে এ সমীক্ষা করা হয়েছিল। যদিও টানেল চালু হয় ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর। ওই সমীক্ষায় বলা হয়, টানেল চালুর বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজারের বেশি গাড়ি চলতে পারে। ২০২০ সালে তা প্রায় ২১ হাজার ও ২০২৫ সালের দিকে প্রতিদিন প্রায় ২৮ হাজারের মতো যানচলাচল করার কথা বলা হয়। অথচ বর্তমানে টানেল দিয়ে গাড়ি পাড় হচ্ছে দৈনিক সাড়ে চার হাজারের মতো। অর্থাৎ বর্তমানে যে পরিমাণ গাড়ি পাড় হচ্ছে তা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩০ শতাংশ। যে কারণে টোল আদায়ও হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ কম।

টানেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে (সিসিসিসি) পাঁচ বছরের জন্য রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। ঠিকাদারকে দিতে হবে বছরে ৬৮৪ কোটি টাকা। সেই হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণের দৈনিক ব্যয় দাঁড়ায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা।

টানেল নিয়ে সমীক্ষায় বলা হয়, প্রতি পাঁচ বছর পর পর একবার টানেলের বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। যাকে বলা হয় ‘রেগুলার মেইনটেনেন্স’। একবার এ ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে প্রায় ১৯ লাখ ডলার ব্যয় করতে হবে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২১ কোটি টাকার সমান।

টানেল নির্মাণে শুরুতেই ব্যয় ধরা হয় আট হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। ব্যয়ের মধ্যে ছয় হাজার ৭০ কোটি টাকাই ঋণ দিয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী শুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘টানেলে যে হারে গাড়ি চলাচলের কথা ছিল বর্তমানে তার চেয়ে অনেক কম গাড়ি চলাচল করছে। আগামীতে যে গাড়ি চলাচল বাড়বে তারও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। টানেল ঘিরে কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প স্থাপনের কথা ছিল তা দৃশ্যমান না হওয়ায় গণপরিবহন কম চলাচল করছে।’

তিনি বলেন, ‘টানেল খাতে যে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে এবং প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে তাতে বলা যায়, আমাদের ঘাড়ে একটি বোঝা হয়েই রয়েছে।’

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীতে ব্রিজ না করে টানেল নামের উচ্চবিলাসী প্রকল্পের আদৌ প্রয়োজনীয়তা ছিল কি না? দেশের অনেক স্থপতি উচ্চবিলাসী এ প্রকল্পের বিরোধিতাও করে সে সময় না করার ওপর যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু বিগত সরকারের সময়ে মেগা প্রকল্প মানেই ছিল, মেগা দুর্নীতি, অর্থের হরিলুট। এ কারণে টানেলের মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করেছিল। টানেলে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, তা দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে দশটি ব্রিজ নির্মাণ করা যেত। যারা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে- তারা সরকারের শেখানো তথ্য পরিবেশন করেছে, ভুল তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘টানেলসহ এসব উচ্চ বিলাসী প্রকল্প সরকারকে অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের সুবিধা দিয়েছিল। এ প্রকল্প কখনও লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা নেই। সরকারের পতন হলেও জনগণের কাঁধে দীর্ঘ স্থায়ী বোঝা চাপিয়ে গেছে। গাড়ি যদি বেশি চলাচল করে, তখন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। অথচ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ টানেল নয়, একটি কালুরঘাট ব্রিজের জন্য দীর্ঘকাল আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। টাকা কম লাগবে, এ কারণে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেনি বিগত সরকার।’

Source link

Related posts

সোনারগাঁওয়ে অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে ট্রাকের ধাক্কায় নিহত ২

News Desk

এক জেলায় ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা

News Desk

নতুন করোনার হটস্পটে বাংলাদেশ

News Desk

Leave a Comment