কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গোসললে নেমে পানিতে ভেসে পর্যটকদের মৃত্যুর হার প্রতি বছর বেড়েই চলছে। স্রোতে ভেসে গত ১০ বছরে ৬৮ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে শেষের তিন বছরে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আহত অবস্থায় অন্তত হাজারো পর্যটককে উদ্ধার করা হয়েছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতের একাধিক স্থানে ভাঙন, গুপ্তখাল, বালুচর এবং বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় সাগরে নামার আগে বিপদ টের পাচ্ছেন না পর্যটকরা। ফলে স্রোতে ভেসে যাচ্ছেন কিংবা আটকা পড়ছেন। পর্যটকদের উদ্ধারের আয়োজনও অপ্রতুল। এসব কারণে সমুদ্রস্নানে যাওয়া পর্যটকদের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। নানা অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেও নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা না হওয়ায় হতাশ পর্যটকরা। আবার সরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় সমালোচনা করেছেন কেউ কেউ।
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লাইফগার্ড সেবা
ভেসে যাওয়া পর্যটকদের প্রাণ রক্ষায় সি-সেফ লাইফগার্ড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে আসছিল। কিন্তু সৈকতের তুলনায় তাদের সদস্য সংখ্যা অপ্রতুল। তার ওপর তহবিলের সংকটের কারণে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে সি-সেফ লাইফগার্ডের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে চাকরি হারাবেন ২৭ জন লাইফগার্ডসহ ৩৫ জন। সেইসঙ্গে ১ অক্টোবর থেকে গোসলে নামা পর্যটকদের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
আন্তর্জাতিক (ইউকে) সংস্থা ‘রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট’-এর (আরএনএলআই) অর্থায়নে ২০১২ সাল থেকে সি-সেফ লাইফগার্ড সৈকতে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। গত ১২ বছরে ২৭ জন লাইফগার্ড কর্মী সৈকতের কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সময় অন্তত ৮০৭ পর্যটককে উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচিয়েছেন।
৬৮ লাশ উদ্ধার
২০১৫ সাল থেকে সৈকতে গোসলে নেমে চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৬৮ জনের। এর মধ্যে শেষের তিন বছরে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। একই সময়ে লাইফগার্ড সদস্যরা ৮০৭ জন পর্যটককে জীবিত উদ্ধার করেছেন বলে জানালেন সি-সেফ লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সৈকতে গোসলে নেমে পানিতে ভেসে প্রাণহানির ঘটনা প্রতি বছর বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। ২০১২ সালে সি-সেফ লাইফগার্ড চালুর পর থেকে মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, প্রতি বছর বেড়েই চলছে মৃত্যুর মিছিল। ২৭ জন কর্মী নিয়ে বিশাল সমুদ্রসৈকত সামাল দেওয়া আমাদের পক্ষে আসলেই কঠিন। তার ওপর চলতি মাসে তহবিলের সংকটের কারণে আমাদের সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। সেবা বন্ধ হয়ে গেলে পর্যটকদের ঝুঁকি আরও বাড়বে। সেইসঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাবে।’
সি-সেফ লাইফগার্ডের তথ্যমতে, সৈকতে গোসলে নেমে স্রোতে ভেসে ২০২৩ সালে ছয় জন, ২০২৪ সালে ১২ জন, চলতি বছর ১৬ জনসহ তিন বছরে ৩৪ পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ৭ সেপ্টেম্বর লাবণী পয়েন্টে গোসলে নেমে নিখোঁজ হয় বগুড়ার কলেজছাত্র জুহায়ের আয়মান (১৭)। সে ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের খালাতো ভাই শরিফুল ইসলামের ছেলে। পরদিন সমিতিপাড়া সৈকত থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত ৭ জুলাই হিমছড়ির সৈকত এলাকায় গোসলে নেমে ভেসে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী অরিত্র হাসান, কে এম সাদমান রহমান ও আসিফ আহমেদ। দুই ঘণ্টা পর হিমছড়ি সৈকতেই কে এম সাদমান রহমানের লাশ ভেসে আসে। পরদিন ৮ জুলাই সকাল ৯টার দিকে ঘটনাস্থলের প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক শুঁটকিমহাল সৈকতে পাওয়া যায় আসিফ আহমেদের লাশ; কিন্তু দুই মাসের বেশি সময় পার হলেও অরিত্র হাসানের সন্ধান মেলেনি।
হোটেল মালিকদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতি বছর কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে আসেন অন্তত ৭০ লাখ পর্যটক। পাঁচ কিলোমিটারে লাইফগার্ড সেবা থাকলেও আরও ১১৫ কিলোমিটার সৈকত অরক্ষিত থাকে। লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হলে পর্যটকরা নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বেন। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে ৬০-৭০ লাখ মানুষ সৈকত ভ্রমণে আসছেন, তাতে ভাটা পড়বে। সরকারি উদ্যোগে লাইফগার্ড সেবা চালু রাখা দরকার।
সৈকতে গোসল আগের চেয়ে কেন বিপজ্জনক?
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সমুদ্রের স্রোতে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতের একাধিক স্থানে ভাঙন, গুপ্তখাল, বালুচর ও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারে ৬০ জনের বেশি লাইফগার্ড ও বিচকর্মী থাকলেও বাকি ১১৫ কিলোমিটার অরক্ষিত। অরক্ষিত দরিয়ানগর, হিমছড়ি, ইনানী, পাটোয়ার টেক ও টেকনাফ সৈকতে গোসলে নামছেন হাজারো পর্যটক। স্রোতের টানে সেখানে কেউ ভেসে গেলে উদ্ধারের কেউ নেই। এসব কারণে সৈকতে গোসল করা আগের চেয়ে বিপজ্জনক।
এ ছাড়া লাবণী পয়েন্টে সবসময় পর্যটকদের ঢল থাকে। এই সৈকতে কয়েকদিন আগে সৃষ্টি হয়েছে বড় দুটি খাল। জোয়ার-ভাটার কারণে খালের দিক পরিবর্তন হয় বলে এই খালকে বলা হচ্ছে গুপ্তখাল। সম্প্রতি এই গুপ্তখালে আটকা পড়ে দুই পর্যটকের মৃত্যু হয়। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় অন্তত ১৫ পর্যটককে উদ্ধার করা হয়।
দুর্ঘটনার ‘বড় কারণ’ অসচেতনতা
গুপ্তখালের আশপাশে (বালুচরে) লোকজনকে গোসলে নামতে নিষেধ করে ওড়ানো হচ্ছে একাধিক লাল নিশানা। পর্যটকদের সতর্ক করতে চলছে প্রচার। কিন্তু সেদিকে কারও নজর নেই। রোদ ও দাবদাহের মধ্যে লোকজন সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছেন, লোনাপানিতে শরীর ভিজিয়ে ফিরছেন হোটেলে। লাবণী পয়েন্টের উত্তর দিকে সিগাল, সুগন্ধা ও কলাতলী সৈকতের অবস্থা আরও ভয়াবহ। চারটি পয়েন্টের অন্তত পাঁচ কিলোমিটার সৈকতে নামছেন হাজারো পর্যটক। অর্ধেক মানুষ সমুদ্রের পানিতে, বাকিরা বালুচরে পাতা ছাতার নিচে বিশ্রাম নিচ্ছেন। বেসরকারি লাইফগার্ড সি সেফ প্রতিষ্ঠানের ২৭ জন এবং জেলা প্রশাসনের নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৭ জন বিচকর্মী গোসলে নামা পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। সাতার না জানা অনেকে টিউবে গা ভাসিয়ে গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যান। বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উল্লাসে মাতে তরুণ-কিশোরের দল। হলুদ শার্টের লাইফগার্ড কর্মীর চোখ সেদিকে। তারা বাঁশি বাজিয়ে, কাছে গিয়ে তাদের সতর্ক করেন। কাউকে জোর করে কূলে তুলে আনছেন। কিন্তু এক দিক থেকে তুলে আনলেও অন্য দিক থেকে আরও লোকজন গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যান।
সি-সেফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার সিফাত সাইফুল্লাহ জানিয়েছেন, কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক গোসলে নামেন। অনেকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমুদ্রে গোসলে নেমে বিপদে পড়ছেন। লাবণী পয়েন্টে বড় দুটি গুপ্তখালের সৃষ্টি হয়েছে। ওই গুপ্তখালে আটকা পড়ে একাধিক পর্যটকের মৃত্যু হয়। লাবণী, সুগন্ধা, সিগাল ও কলাতলী সৈকতে গোসলে নেমে স্রোতে ভেসে যাওয়ার সময় অন্তত শতাধিক পর্যটককে উদ্ধার করা হয়েছে। বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে গুপ্তখালে। সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে লাইফগার্ড কর্মীরা লাল-হলুদ এবং লাল পতাকা নিশানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এগুলো কখন ও কোথায় সমুদ্রের পানিতে যাওয়া নিরাপদ, তার নির্দেশনা বহন করে। লাল রঙের পতাকা মানে সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। আর লাল-হলুদ পতাকার অর্থ সমুদ্রে গোসল করা নিরাপদ। গোসলের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে লাল-হলুদ পতাকা লাগানো জায়গায় থাকতে হবে। কোনও অবস্থায় লাল পতাকা লাগানো জায়গা অতিক্রম করা যাবে না। কিন্তু অনেকে জেনেও লাল পতাকার স্থানে চলে যান।
রিপ কারেন্ট থেকে সাবধান
রিপ কারেন্ট হলো সৈকতের কাছাকাছি তৈরি হওয়া ঢেউয়ের একটি শক্তিশালী অবস্থা। যা ঢেউ ভেঙে দ্রুতগামী স্রোতকে সমুদ্রের দিকে দ্রুত টেনে নিয়ে যায়। তখন সরু স্রোতটি রিপ কারেন্ট হিসেবে প্রবাহিত হয়। এজন্য রিপ কারেন্ট বলা হয়। এটি পানিকে সমুদ্রের দিকে দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণে পর্যটকদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। শুধু পর্যটক নয়, এই ঢেউ যেকোনো দক্ষ সাঁতারুকেও খড়কুটোর মতো দ্রুত সমুদ্রের গভীরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এ সময় কোনোভাবেই সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। যথাসম্ভব আগে থেকেই লাইফগার্ড কর্মীদের কাছ থেকে রিপ কারেন্টের সময়ের ব্যাপারে জেনে নিতে হবে।
রিপ কারেন্টে পড়লে করণীয়
এ অবস্থায় পড়ে গেলে সৈকতের সমান্তরালভাবে সাঁতার কেটে স্রোত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। অর্থাৎ স্রোতের বিপরীতে সরাসরি সাঁতার কাটা যাবে না। সৈকতের দিকে সাঁতার কেটে ফেরার চেষ্টা করতে হবে। যাতে স্রোতের টান থেকে কিছুটা দূরে পৌঁছানো যায়।
সৈকতের তিন পয়েন্ট ছাড়া কোথাও নেই লাইফগার্ড সেবা
লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্ট ছাড়া আর কোথাও লাইফগার্ডকর্মী নেই। সৈকতের মাত্র পাঁচ কিলোমিটারে উদ্ধার তৎপরতার কাজ করা হলেও অবশিষ্ট সৈকত অরক্ষিত পড়ে থাকছে। বিশেষ করে উখিয়ার ইনানী, পাটুয়ারটেক, রামুর হিমছড়ি, টেকনাফ, বাহারছড়া, সদরের দরিয়ানগর পয়েন্টে কেউ গোসলে নেমে নিখোঁজ হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর কেউ নেই।
সি-সেফ লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে ৩৫ জন কর্মরত। আমরা শুধু জেলা শহরের তিন পয়েন্টে সেবা দিচ্ছি। এখন সময় বদলে গেছে, কক্সবাজারে ভ্রমণে আসা পর্যটকরা ছড়িয়ে পড়ছেন হিমছড়ি, ইনানী, পাঠুয়ারটেক, টেকনাফসহ সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে। ওসব স্থানে যদি পর্যটকদের গোসল নিরাপদ করতে না পারলে মৃত্যু অনেকাংশে বেড়ে যাবে।’
লাইফগার্ড যেভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালায়
সৈকতে গোসলে নেমে ভেসে যাওয়া পর্যটকদের রেসকিউ বোট ও টিউব দিয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালান লাইফগার্ড সদস্যরা। এ ছাড়া জেটস্কি ও স্পিডবোট দিয়েও উদ্ধার তৎপরতা চালানো হয়।
গত শনিবার সুগন্ধা পয়েন্টে দেখা গেছে, সৈকতে গোসল করছেন অনেক পর্যটক। চৌকিতে বসে, বালুচরে দাঁড়িয়ে কিংবা কোমরসমান পানিতে নেমে পর্যটকের নিরাপত্তা দিচ্ছেন কয়েকজন লাইফগার্ড। ঢেউয়ের ধাক্কায় কোনও পর্যটক টিউব থেকে ছিটকে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করে আনছেন লাইফগার্ডরা। লাইফগার্ডদের পরনে থাকে লাল-হলুদ টি-শার্ট ও প্যান্ট। মুখে বাঁশি, হাতে উদ্ধার সরঞ্জাম।
লাইফগার্ডরা বলছেন, সমুদ্রসৈকত দেশের সম্পদ। একদিকে সৈকতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বৃদ্ধি যেমন জরুরি, অন্যদিকে পর্যটকদেরও উচিত নিজের ও অন্যের প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে সতর্ক থাকা। পানিতে নামার সময় দুর্ঘটনা এড়িয়ে সতর্ক ও করণীয় যথাযথ পালনের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানো যেতে পারে।
গোসলে নামার আগে যা জানা জরুরি
১) সৈকতে লাল-হলুদ পোশাক পরিহিত লাইফগার্ড কর্মীদের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। ২) সি-সেফ লাইফগার্ডের নির্দেশিত স্থান ব্যতীত অন্য কোথাও পানিতে নামা যাবে না। ৩) সৈকতে লাল পতাকা চিহ্নিত স্থানে কোনোভাবেই নামা যাবে না। ৪) সৈকতে সবসময় লাল-হলুদ পতাকার মধ্যবর্তী স্থানে পানিতে নামতে হবে। ৫) সৈকতের নামার আগে অবশ্যই জোয়ার-ভাটাসহ আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। ৬) লাইফ জ্যাকেট ছাড়া হাঁটুপানির বেশি গভীরে যাওয়া যাবে না। ৭) সৈকতের পানিতে প্রায় সময়ে শিশুরা হারিয়ে যায়, তাই শিশুদের দেখেশুনে রাখতে হবে, একা ছাড়া যাবে না। ৮) যেকোনো বিপদে জেলা প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশ, বিচকর্মী এবং লাইফগার্ড কর্মীদের সহযোগিতা নিতে হবে।
দুশ্চিন্তায় লাইফগার্ড কর্মীরা
দীর্ঘ সময় ধরে লাইফগার্ডের সেবা দিচ্ছেন নাইক্ষ্যংছড়ির জয়নাল আবেদীন ও কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়ার মো. ওসমান। জয়নাল জানান, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি একাই ৯৮ জন পর্যটকের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছেন। লাইফগার্ড ছাড়া অন্য কিছু করে সংসার চালানোর মতো কাজও এলাকায় নেই। একই কথা বলেছেন ওসমান। তিনি বলেন, ‘কোনও পর্যটক ভেসে গেলে আমরা ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাঁচাই, এখন আমাদের জীবনটাই ঝুঁকিতে পড়ে গেলো। আমাদের বাঁচানোর কেউ নেই।’
প্রশাসনের পদক্ষেপ কী
হোটেল ব্যবস্থাপনার নীতিমালায় লাইফগার্ড পরিচালনার বিষয়টি উল্লেখ আছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মালিকদের বলা হয়েছে, হোটেলের অর্থায়নে লাইফগার্ড সেবা চালু রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সৈকত এলাকার বড় (তারকা) হোটেলগুলো তিন জন এবং ছোট হোটেলগুলোকে একজন করে লাইফগার্ডের বেতন পরিশোধ করতে হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান লাইফগার্ডদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যেহেতু তারা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কিন্তু হোটেলমালিকরা জেলা প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ।
কক্সবাজার হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান জানিয়েছেন, হোটেলমালিকদের ব্যবস্থাপনায় ২৭ জন লাইফগার্ড পরিচালনার নির্দেশনা পর্যটন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হলেও হোটেলমালিকরা মাসে ১৪-১৫ লাখ টাকার জোগান দিতে পারবে কিনা, সন্দেহ আছে। তাতে কেউ সাড়া দিচ্ছেন না। দিলেও সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এক্ষেত্রে আগামী অক্টোবর মাস থেকে লাইফগার্ড সেবা চালু করা সম্ভব হবে না। লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হয়ে গেলে পর্যটকরা নিরাপত্তার হুমকিতে পড়বেন। এজন্য সরকারি উদ্যোগে লাইফগার্ড সেবা চালু রাখা দরকার।
পর্যটন পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এডিআইজি) আপেল মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে সৈকতে লাইফগার্ড সেবা কার্যক্রম অতি জরুরি। কোনোভাবেই এই সেবা কার্যক্রম বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না। প্রকল্পটি চালু রাখতে জেলা প্রশাসনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে আবেদন জানিয়েছি আমরা। দ্রুত একটি ইতিবাচক বার্তা পাওয়ার আশা করছি।’
সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার দাবি
সি-সেফ লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘তহবিলের সংকটের কারণে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সি-সেফ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে জেলা প্রশাসকের তৎপরতায় দাতা সংস্থা প্রকল্পের মেয়াদ গত জুন পর্যন্ত ছয় মাস বর্ধিত করে। এরপর দ্বিতীয় দফায় ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও তিন মাস বাড়ানো হয়। অর্থের জোগান না হওয়ায় চলতি সেপ্টেম্বরেই লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানে ২৭ জন লাইফগার্ডসহ মোট ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিপরীতে মাসে গড়ে ১৪ লাখ টাকা জোগান দিতো সংস্থাটি। এখন অর্থ না দিলে আমাদের সেবা দেওয়ার মতো অবস্থা থাকবে না। পাশাপাশি সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জানিয়েছেন, তহবিলের সংকটের কারণে লাইফগার্ড সেবা এই সেপ্টেম্বরে বন্ধ হওয়ার বিষয়টি পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা হচ্ছে, সৈকত এলাকার হোটেলগুলোর মাধ্যমে লাইফগার্ড সেবা চালু রাখতে হবে।