বিদ্যুতের ব্যবহারসহ সব বিষয়ে জনগণকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (যুগান্তর অনলাইন, ১৯ জুলাই ২০২২)

জনগণকে অপচয় কমানো এবং সঞ্চয়ের অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (বাংলা ট্রিবিউন, ১১ অক্টোবর ২০২২)

সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ-খাদ্যসংকট থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করুন: প্রধানমন্ত্রী (বাসস, ১৭ অক্টোবর ২০২২)

ওপরের তিনটি বক্তব্যই একজনের, তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেও মিতব্যয়ী থেকেছেন—বিভিন্ন সময় নিজের সম্পর্কে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। এ কারণে জনগণকেও তিনি অনেক দিন ধরে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে ওপরের বক্তব্যগুলো তিনি দিয়েছেন গত তিন মাসের মধ্যে। তাঁর এই বক্তব্যগুলোর প্রেক্ষাপট আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না।

 

 

জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গত ১৯ জুলাই সারা দেশে কয়েক ঘণ্টা করে লোডশেডিং শুরু হয়। সেদিনই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুতের ব্যবহারসহ সব বিষয়ে জনগণকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় বক্তব্যটিও একনেকের সভায় দেওয়া। ১১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ওই সভায় তিনি খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা জানিয়ে জনগণকে অপচয় কমানো এবং সঞ্চয়ের অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয় বক্তব্যটি ১৭ অক্টোবরের। ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২২’ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যসংকট থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সম্ভাব্য খাদ্যসংকটের পাশাপাশি দেশ যে অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে, দৈনন্দিন জীবনযাপনে সাধারণ মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যগুলো সেই সংকট ও দুরবস্থার একটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও বটে। এ রকম অবস্থায় জনগণকে মিতব্যয়ী হওয়া, অপচয় কমানো ও সঞ্চয়ের ‘পরামর্শ’ দেওয়া সরকারের প্রধান নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর জন্য খুবই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। দেশের বহু মানুষ হয়তো তাঁর এ পরামর্শকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন এবং কৃচ্ছ্রসাধন শুরু করেছেন। কিন্তু প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা কি এসবের ঊর্ধ্বে? প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ কি তাঁদের জন্য প্রযোজ্য নয়? নাকি সরকার তাঁদের জন্য ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ করেছে?

এ প্রশ্নগুলো উঠছে কারণ, জনগণকে মিতব্যয়ী হওয়ার প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক আহ্বানের মধ্যেই জানা গেল, জনপ্রশাসনের শীর্ষ দুটি পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের জন্য ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাসভবন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সরকারি তহবিল থেকে এ টাকার জোগান দেওয়া হবে। রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন এলাকায় পাশাপাশি নির্মিত হবে ভবন দুটি (প্রথম আলো, ১৮ অক্টোবর)।

প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুসারে ভবন দুটি হবে তিনতলা। সাড়ে ১৮ হাজার বর্গফুটের প্রতিটি ভবন নির্মাণে ব্যয় হবে সাড়ে ২১ কোটি টাকা। দুটি ভবনেই অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাতে খরচ হবে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। দুটি ভবনে আসবাবের পেছনে খরচ হবে দেড় কোটি টাকা। ২টি ভবনের জন্য ৭টি করে মোট ১৪টি এলইডি টেলিভিশন কেনা হবে। এতে ব্যয় হবে ৯ লাখ টাকা। সিসিটিভি সিস্টেম কেনা হবে ৩২টি। তাতে খরচ হবে ৬০ লাখ টাকা। অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থার জন্য পৌনে দুই কোটি টাকা খরচ হবে। এক হাজার কেজি লিফটে (ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড) খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থায় খরচ হবে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

প্রতিটি বাসভবনে দুই সেট সুইমিংপুল হবে। এতে খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। প্রথম আলোর প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সুইমিংপুল বানাতে এত টাকা খরচের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছেন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার। আন্তমন্ত্রণালয় সভায় তিনি সুইমিংপুলের খরচকে অতিরিক্ত বলেছেন। কিন্তু সুইমিংপুল ছাড়াও বাড়ি দুটি নির্মাণ ও অন্যান্য সাজসজ্জার খরচও লাগামছাড়া। খরচের এই আতিশয্যকে বিলাসিতা বলা যেতেই পারে।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর বরাত দিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা চলছে। নকশা ও স্থান চূড়ান্ত করতে অনেক সময় চলে গেছে।…তাঁর এ বক্তব্য থেকে মনে হতে পারে, দেশে অর্থনৈতিক সংকট না থাকলে দুই শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তার জন্য ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবন নির্মাণ খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে এখনো লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন, সেই দেশে কোনো অবস্থাতেই এটা স্বাভাবিক হতে পারে না। সরকারি তহবিল মানে জনগণের করের টাকায় জনপ্রশাসনের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার জন্য এমন ‘ব্যয়বহুল’ ‘বিলাসী’ বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত সবার তাই লজ্জিত হওয়া উচিত।

সরকারি দায়িত্ব ও কর্মপরিধির কারণে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব—উভয়ই সরকার প্রধানের ‘বিশ্বস্ত’ লোক হয়ে থাকেন এবং তাঁদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। সরকারের নীতি-পরিকল্পনা কিংবা প্রধানমন্ত্রীর আদেশ-নির্দেশ-পরামর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জনগণকে মিতব্যয়ী হওয়ার প্রধানমন্ত্রীর যে পরামর্শ, ‘কাছের মানুষ’ হিসেবে সর্বাগ্রে তাঁদের জন্যই সেটা প্রযোজ্য হওয়া উচিত। সেই বিবেচনায় এই দুই কর্মকর্তার জন্য বিলাসী বাড়ি নির্মাণে সরকারের পরিকল্পনা একটি স্ববিরোধী অবস্থান।

বেশ কয়েক বছর ধরেই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি, গাড়ি ও বাড়ির জন্য ঋণসহ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো যৌক্তিকভাবেই তাঁরা এগুলো পেয়েছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের বিরুদ্ধে আমলাতন্ত্র এবং বিশেষভাবে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ‘সন্তুষ্ট’ বা ‘পক্ষে’ রাখার অভিযোগও উঠছে। দুই সচিবের জন্য ৪৩ কোটি টাকার বাড়ি সে রকম কোনো পরিকল্পনার অংশ কি না, আমরা তা জানি না। কারণ যা-ই হোক, একদিকে সরকার প্রধানের মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান আর অন্যদিকে সচিবদের জন্য বিলাসবহুল এই বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা চরম স্ববিরোধী অবস্থান ছাড়া আর কিছুই নয়।

Related posts

২৫ দিন পর বাসভবন থেকে বের হলেন শাবিপ্রবি উপাচার্য

News Desk

ডোমারে টাকা নিয়ে ভোট না দেওয়ায় ইউপি সদস্যকে মারধর

News Desk

রাজশাহীতে তীব্র গরম, অতিষ্ঠ জনজীবন

News Desk

Leave a Comment