ব্রহ্মপুত্রের চরে টিকে থাকার লড়াই, পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা
বাংলাদেশ

ব্রহ্মপুত্রের চরে টিকে থাকার লড়াই, পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা

‘ঘর তলায় গ্যাছে। টিউবওয়েল তলায় গ্যাছে। খাওনের পানির খুব কষ্ট। পচা পানি (নদীর ঘোলা পানি) কি খাওয়োন যায়? নাও (নৌকা) নিয়া উত্তর থাইকা (গ্রামের উত্তর প্রান্ত থেকে) একবার পানি আইনা সারাদিন সেই পানি খাই। পানি আর রান্ধনের খুব কষ্ট হইছে।’ ব্রহ্মপুত্রের পানিতে প্লাবিত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে নিজেদের দুর্ভোগের কথা এভাবেই বলছিলেন সবুরা খাতুন (৫৫)।

সবুরার বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের বতুয়াতলির চরে। তার থাকার ঘরে বুক সমান পানি। রান্নাঘর, টিউবওয়েল ও শৌচাগার সবই তলিয়েছে। বাড়ির এক কোণে অর্ধ নিমজ্জিত সাত ফুট উচ্চতার মাটির ঢিবি। দুর্যোগ পরিস্থিতিতে গবাদিপশু রাখার জন্য তৈরি সেই ঢিবিতে খাটের ওপর মেয়ে, নাতি আর ছেলের বৌকে নিয়ে বসে আছেন সবুরা। খাটের পাশে চুলা। পাশে বেঁধে রাখা কয়েকটি ছাগল খড় খাচ্ছিল। শেষ আশ্রয়স্থল সেই ঢিবিও পানিতে নিমজ্জিত প্রায়। এমন পরিস্থিতিতে নির্বিকার বসে সবুরা।

দুর্যোগে কোনোমতে জীবনের হাল ধরে রাখা এই নারী বলেন, ‘তিন দিন থাইকা ঘরে পানি। গরু ছাগল নিয়া এই উঁচা জায়গায় আছি। এহানেই এক বেলা রাইন্ধা খাই। সেহানেও পানি উঠতাছে। চুলা রাখুম সেই জায়গাও পানিতে তলাইতাছে। রান্ধনের উপায়ও শ্যাষ।’

বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সবুরার সঙ্গে যখন কথা হয় ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা পেরিয়েছে। বাড়ির পুরুষ সদস্যরা নৌকায় গরু নিয়ে পাশের চরে উঁচু স্থানে রাখতে গেছেন। নারী ও শিশুরা বাড়িতে পানিবন্দি। বাড়ির চারপাশ দিয়ে বিশাল জলরাশি নিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আসা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যার তথ্য বলছিল, আগামী ২৪ ঘণ্টা ভারী বৃষ্টিপাত এবং পরবর্তী তিন দিন বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। আশঙ্কাময় এই সতর্কবার্তা সবুরা ও তার প্রতিবেশীদের অজানা।

আশ্রয়কেন্দ্রে  যাওয়া প্রশ্নে সবুরা বলেন, ‘কেমনে যাবু। খরচা আছে না! কই পামু? বাড়িতে থাইকা দেহি কী হয়!’

সবুরার বাড়ির ঠিক উত্তরে মৎস্যজীবী আলামিনের সংসার। তার বাড়িতেও বুক সমান উচ্চতার পানি। তলিয়ে আছে বতসঘরসহ সবকিছু। শুধু গরু ছাগল রাখার ঝুপড়িটা সামান্য জেগে আছে। সেই ঝুপড়িতে ১০/১২টি গরু, কয়েকটি ছাগল আর মুরগিসহ তিনদিন ধরে বসবাস করছে আলামিনের পরিবার। ঝুপড়িতে দেখা মিললো আলামিনের স্ত্রী আইরিনের। ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আইরিন তিন বছরের শিশু সন্তান আর কিশোরী ননদকে নিয়ে চকির ওপর বসে আছেন।

সংবাদকর্মীদের দেখে অনেকটা অপ্রস্তুত আইরিন বলেন, ‘ঘরে থাকনের কোনও উপায় নাই। সবাই মিলে গরুর ঘরে থাকি। এহানেই রান্ধি, এহানেই খাই। বৃষ্টি এলে বইসা থাকতে হয়, ঘুমাতেও পারি না। খাবার পানির খুব কষ্ট। অহন ঘরে এক ফোটা পানিও নাই। সকালে যা আইনা দিছে তা শ্যাষ হইছে।’

ব্রহ্মপুত্রের চরে টিকে থাকার লড়াই, পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা

চর বতুয়াতলির গৃহবধূ আইরিন আর সবুরার মতো ব্রহ্মপুত্রের সব চরজুড়ে এখন বাসিন্দাদের টিকে থাকার লড়াই। ঘোলা পানিতে উপচে পড়া এ নদ প্লাবিত করেছে হাজারো পরিবারের বসতভিটা। টিউবওয়েল, শৌচাগার, চলাচলের রাস্তা সবকিছুই তলিয়েছে। পানিবন্দি অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। নারী-শিশু ও গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে বানভাসি পরিবারগুলো।

বতুয়াতলির দক্ষিণে একই ইউনিয়নের মশালের চরে একই দৃশ্য, প্রায় সব পরিবার পানিবন্দি। খানিকটা উত্তরপূর্বে সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের কালিরআলগা (ক্যাচালের চর) গ্রামে দুই শতাধিক পরিবারের বসবাস। বাসিন্দাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে খানিকটা উঁচু ও উজানে অবস্থান করা এই গ্রামকেও প্লাবিত করেছে ব্রহ্মপুত্র। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই পানি। প্রায় প্রতিটি বসতঘরের ভেতরে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি।

কালিরআলগা গ্রামের বয়োবৃদ্ধ বাসিন্দা সন্তোষ আলীর চারটি ঘরেই পানি। স্ত্রীসহ খাটের ওপর বসে আছেন সন্তোষ। ঘরের জিনিসপত্র উঁচুতে তোলা।

ব্রহ্মপুত্রের চরে টিকে থাকার লড়াই, পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা

সন্তোষ বলেন, ‘চারদিন ধইরা ঘরে পানি। খড়ি নাই, চুলা জ্বালান যায় না। রান্নার কষ্ট। একবেলা খাইলে আর খাওয়োন হয় না।’

ওই গ্রামের বাসিন্দা আমজাদ ও জাহাঙ্গীর বলেন, ‘খড়ি আর চুলার অভাবে রান্ধন হয় না। না খাইয়ায় থাকতে হয়। যার খড়ি আছে তারা নাওয়ে (নৌকায়) রাইন্ধা খায়।’

যাত্রা পথে গ্রামগুলো দেখে মনে হচ্ছিল নদের বুকে একেকটা ভাসমান বসতি। যাত্রাপুর ইউনিয়নের শিবেরগাছী, পোড়ারচর, গোয়াইলপুরের চর, খোকার চর, উলিপুরের সাহেবের আলগা ইউনিয়নের চর আইড়মারি, দই খাওয়ার চরসহ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার চরগুলো উজানের পানিতে প্লাবিত। এসব চরের প্রায় সব বাসিন্দাদের বসতঘরে পানি। পানিবন্দি মানুষের স্থবির ও সীমাবদ্ধ জীবন। এমন মানবেতর পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসন খাদ্য সহায়তা বিতরণে জোর দিয়েছে। সদর, উলিপুর, চর রাজিবপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়ী উপজেলায় দুর্গত পরিবারের মাঝে খাদ্য সহায়তা বিতরণ চলমান রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে পাউবোর বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী তিন দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

পাউবো, কুড়িগ্রামের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, চার দিন ধরে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শুক্রবার সকাল ৯টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, নাগেশ্বরীর নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ও উলিপুরের হাতিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দুধকুমারের পানি রাতভর বাড়লেও তা বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ধরলা ও তিস্তার পানির সমতল সামান্য কমেছে।

জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার দেওয়া তথ্য মতে, জেলার ছয়টি উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ৩৫০ দশমিক ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়ে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তা বিতরণ জোরদার করা হয়েছে। জেলায় মোট ৪০৪টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং দুর্গতদের উদ্ধারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নৌযান প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে উপজেলাগুলোতে ৯০ মেট্রিক টন চাল ও তিন হাজার ২৬৭ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। নতুন করে আরও ৫০০ মেট্রিক টন চাল ও ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সরকার সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে দুর্গত মানুষদের পাশে রয়েছে।’

Source link

Related posts

টেকনাফের দুর্গম পাহাড় থেকে ৬ ডাকাত গ্রেফতার, অস্ত্র উদ্ধার

News Desk

মান্দায় ৫মাস পরেও মেলেনি মরদেহের পরিচয়

News Desk

বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দেশকে আর্থিকভাবে বিপদে ফেলা হচ্ছে: রেহমান সোবহান

News Desk

Leave a Comment