গত বছরের ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের নানুয়াদিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি জেলায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল। এসব ঘটনায় কুমিল্লায় একজন, চাঁদপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পাঁচ জন ও পরদিন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে দুই জন নিহত হন।
কুমিল্লার ঘটনায় ১২, চাঁদপুরের ঘটনায় ১০ ও বেগমগঞ্জের ঘটনায় ২৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় তিন শতাধিক ব্যক্তি কারাগারে রয়েছেন।
কুমিল্লার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নগরীর পাথুরিয়াপাড়া এলাকার ইকবাল হোসেনকে শনাক্ত করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার পর হনুমানের মূর্তি থেকে গদাটি কাঁধে নিয়ে চলে যান। ফুটেজে পরিষ্কারভাবে দেখা গেছে, ইকবাল কীভাবে মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন হাতে নিয়ে পূজামণ্ডপে গেছেন। পরে মাজারের খাদেমসহ দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা হলেন ফয়সাল ও হাফেজ হুমায়ুন। এরপর জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল দিয়ে ঘটনার বিষয়ে জানানো ইকরামকে গ্রেফতার করা হয়।
২৩ অক্টোবর কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিথিলা জাহান নিপার আদালতে চার জনকে হাজির করা হয়। পরে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন: কোরআন রেখে হনুমানের গদা নিয়ে পুকুরে ফেলে দেন ইকবাল
এর আগে গত ২১ অক্টোবর রাতে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকায় ঘোরাফেরা করার সময় ইকবাল হোসেনকে গ্রেফতার করে কক্সবাজার জেলা পুলিশের একটি দল। ২২ অক্টোবর দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে তাকে কুমিল্লায় আনা হয় এবং সেখানে পুলিশ লাইনসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেদিন মাজারের দুই খাদেমের সঙ্গে কথা বলে কোরআন নিয়ে যান বলে জানান ইকবাল।
ইকবাল কোথায়?
বর্তমানে ইকবাল কোথায়? মামলাগুলোর তদন্ত কতদূর এগিয়েছে, তা নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে বাংলা ট্রিবিউন। এতে দেখা গেছে, কুমিল্লায় সহিংসতার ঘটনায় হওয়া ১২ মামলার তদন্তের তেমন কোনও অগ্রগতি নেই। আসামিদের আদালতে হাজিরা দেওয়া এবং কারাগারে যাওয়ার মধ্যেই তদন্তকাজ সীমাবদ্ধ। নতুন করে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ঘটনায় জড়িতদের পেছনে কারা রয়েছেন, অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তারা। তবে তাদের দাবি, মামলার তদন্তে অগ্রগতি আছে। সে অগ্রগতি কি তা জানাতে পারেননি তারা।
মামলা ও গ্রেফতার
সিআইডি, পিবিআই ও থানা পুলিশ জানায়, পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার ঘটনায় কুমিল্লার সদর দক্ষিণ থানায় দুটি এবং কোতোয়ালি মডেল থানায় ১০টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর ছয়টি তদন্ত করছে সিআইডি। এই ছয় মামলায় এখন পর্যন্ত ৬৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে কোতোয়ালি থানায় করা সহিংসতার একটি মামলায় ৪৪ জনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে সিআইডি। সদর দক্ষিণ থানায় সহিংসতার দুই মামলায় ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে করা মামলায় ইকবালসহ চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কোতোয়ালি থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা দুই মামলায় চার জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।
আরও পড়ুন: ইকবাল ও মাজারের খাদেমদের ৭ দিনের রিমান্ড
সদর দক্ষিণ থানার ওসি দেবাশীষ চৌধুরী বলেন, ‘সহিংসতার ঘটনায় আমাদের থানায় দুটি মামলা হয়েছিল। মামলাগুলো তদন্ত করছে সিআইডি। এসব মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।’
এদিকে, কোতোয়ালি থানায় সহিংসতার ঘটনায় দুই মামলায় গ্রেফতার সাত জন কারাগারে রয়েছেন। কোতোয়ালি থানার ওসি সহিদুর রহমান বলেন, ‘সহিংসতার ঘটনায় এই থানায় ১০টি মামলা হয়েছিল। দুটি মামলা আমরা তদন্ত করছি। এই দুই মামলায় সাত জন গ্রেফতার ছাড়া কোনও অগ্রগতি নেই। চারটি মামলা তদন্ত করছে পিবিআই। অপর চারটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। তাদের কাছে অগ্রগতি থাকলে থাকতে পারে।’
পিবিআই জানায়, চার মামলার মধ্যে কুমিল্লা নগরীতে সহিংসতায় নিহত দিলীপ কুমার দাসের হত্যা মামলাও রয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: পূজামণ্ডপে কোরআন রাখা কে এই ইকবাল?
পিবিআইয়ের কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘চার মামলায় পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যুর আগে একটি মামলা করেছেন দিলীপ কুমার দাস। পুরো ঘটনার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করছি আমরা। ঘটনায় নতুন করে কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।’
ইকবাল এখন কোথায় সেই তথ্য কুমিল্লার বিশেষ পুলিশ সুপার (সিআইডি) খান মোহাম্মদ রেজওয়ানের কাছে জানতে চেয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি।
খান মোহাম্মদ রেজওয়ান বলেন, ‘পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার ঘটনা নিয়ে কয়েকটি জেলায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল। এজন্য বিভিন্ন জেলায় ইকবালের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর হাজিরা দিতে কুমিল্লা থেকে ইকবালকে বিভিন্ন জেলার আদালতে হাজির করতে হয়। বর্তমানে একটি মামলার হাজিরা দিতে তাকে নোয়াখালীর আদালতে নেওয়া হয়েছে। সেখানে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলার কার্যক্রম চলমান। তাই তাকে নোয়াখালীতে রাখা হয়েছে। আগামী রবিবার তাকে কুমিল্লায় আনা হবে।’
মামলার তদন্ত নিয়ে যা বলছেন পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা
পূজা উদযাপন পরিষদ কুমিল্লা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত কুমার দাস টিটু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পূজামণ্ডপে হামলার পেছনে কেউ না কেউ জড়িত আছেই। তা না হলে ইকবাল পবিত্র কোরআন রেখে কেন গদা নিয়ে যাবেন। এছাড়া সেদিন দ্রুত সময়ের মধ্যে এত মানুষ কীভাবে পূজামণ্ডপে জড়ো হলেন। ইকবালের পেছনে কারা? তাদের সহযোগী কারা? এমন নানা প্রশ্ন আছে আমাদের মনে। তবে আমাদের দাবি একটাই, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করেন। তা না হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশকে একটি মহল অশান্ত করে ফেলবে। এর দায় ইকবালদের নয়, বরং ইকবালদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাদেরও নিতে হবে। এজন্য তাদের শনাক্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
মামলা তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা
খান মোহাম্মদ রেজওয়ান বলেন, ‘সিআইডি পুরো ঘটনাটি তদন্ত করছে। ঘটনার আগে এবং পরে পাওয়া সব তথ্য-উপাত্ত পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা। হেডকোয়ার্টার্স থেকে সবকিছু প্রকাশ করা হবে।’
আরও পড়ুন: মাজারের দুই খাদেমের সঙ্গে কথা বলে কোরআন নিয়ে যান ইকবাল
তিনি বলেন, ‘ইকবাল যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেগুলোর সত্যতা যাচাই-বাছাই ছাড়া আমরা কিছু বলতে পারছি না। তবে এটা বলতে পারি, ঘটনার তদন্তে বেশিরভাগ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। সবগুলো বিষয় সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে, এই ঘটনার পেছনে আর কেউ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
আরও পড়ুন: মাজার থেকে যেভাবে কোরআন নিয়ে পূজামণ্ডপে যান ইকবাল
গত ১৩ অক্টোবর ভোরে নানুয়াদিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়া যায়। এ নিয়ে দেশের কয়েক স্থানে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনার জেরে ওই দিন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হিন্দুদের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পাঁচ জন নিহত হন।
পরদিন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হিন্দুদের মন্দির, মণ্ডপ ও দোকানপাটে হামলা–ভাঙচুর চালানো হয়। সেখানে হামলায় দুই জন নিহত হন। এরপর রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু বসতিতে হামলা করে ভাঙচুর, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও গাজীপুরেও হিন্দুদের মন্দির, মণ্ডপ ও দোকানপাটে হামলা চালানো হয়েছিল। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে এবং তিন শতাধিক ব্যক্তি কারাগারে রয়েছেন।