পদ্মাপাড়ে কান্নার রোল, কোথায় যাবেন তারা?
বাংলাদেশ

পদ্মাপাড়ে কান্নার রোল, কোথায় যাবেন তারা?

কুষ্টিয়ার মিরপুরে আগ্রাসী পদ্মার ভাঙনে ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে শত শত একর ফসলি জমি। হুমকির মুখে রয়েছে বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সবশেষ বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) উপজেলার বহলবাড়িয়ার ইউনিয়নের সাহেবনগরে পদ্মা নদীর মধ্য দিয়ে যাওয়া পাওয়ার গ্রিড অব বাংলাদেশের (পিএলসি) ১৩২ কেভি টাওয়ার পোল নদীগর্ভে চলে গেছে। বিদ্যুতের এই টাওয়ারের মাধ্যমে ভেড়ামারা থেকে রাজবাড়ীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। এখন বন্ধ আছে।

পদ্মাপাড়ের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চোখের সামনে বসতভিটা নদীতে চলে যাচ্ছে। কেউ ঘরের খুঁটি, কেউবা টিনের চাল সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন। নারীরা কাপড়চোপড়, বিছানা ও রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছেন নিরাপদ স্থানে। এসব দেখে যমুনাপাড়ে বয়স্ক ও শিশুদের কান্নার রোল পড়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মার তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে মিরপুর উপজেলার তাংবাড়িয়া এবং  বহলবাড়িয়ার দুটি ইউনিয়ন। বিশেষ করে ভাঙনের শিকার হয়েছে তালবাড়িয়ার বারুইপাড়া, খাদিমপুর, সাহেবনগর, মির্জানগর ও ঘোড়ামারাসহ বেশ কিছু এলাকা। এসব এলাকায় বিগত তিন বছর ধরে নদীগর্ভে শত শত একর আবাদি জমি বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে ১৩২ কেভি বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিশন টাওয়ার, বসতবাড়ি, শতবর্ষী স্কুল-কলেজ ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। সেইসঙ্গে কুষ্টিয়া ঈশ্বরদী-পাবনা মহাসড়ক হুমকির মুখে আছে। এখনই ভাঙনরোধ করা না গেলে সড়কটি যেকোনও সময় নদীতে চলে যাবে। 

ভাঙন ঠেকাতে সম্প্রতি কয়েক দফায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করলেও সন্তোষজনক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

সরেজমিনে বহলবাড়িয়া ইউনিয়নের সাহেবনগর পদ্মা নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এই এলাকার অনেক মানুষ ভাঙন আতঙ্কে ঘরবাড়ির আসবাবপত্র নিয়ে চলে গেছেন। নদী পাড়ের অনেক গাছ কেটে নিয়ে গেছেন তারা। আবার অনেককে দেখা যায়, উৎকণ্ঠা নিয়ে নদীর পাড়ে বসে আছেন। ভাঙনরোধে কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে। তবে ভাঙনরোধ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আমাদের শত শত বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন আমাদের বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে আছে। নদী ভাঙতে ভাঙতে আমাদের ঘরের কাছে চলে এসেছে। যেকোনও মুহূর্তে ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ছাড়া নদীভাঙন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ভাঙনরোধে অতি দ্রুত বাঁধ নির্মাণের দাবি করছি আমরা।

সাহেবনগর গ্রামের মোহাম্মদ নূর সালাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘পারমাণবিক (রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র) দেওয়ার কারণে তিন কিলোমিটার নদী এখানে ভেঙে আসছে। আমাদের বাড়িঘর হুমকির মুখে। জমিতো গেছেই, এখন শুধু বাড়িঘরটুকু আছে। তাও ভাঙার মুখে আছে। নদীভাঙন কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, সে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বর্তমান সরকারের কাছে বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই ভাঙার পরও যদি আমার বাড়িঘর টুকু থাকে, সারাদিন কাজ করি। কাজ করে যে মাথার নিচে যদি ছাদ না থাকে আমরা থাকবো কোথায়? আমাদের বিশাল সমস্যা। সরকারের কাছে আকুল আবেদন যত দ্রুত এই কাজটা যেন করে দেয়।’  

নদী তীরে দাঁড়িয়ে ছিলেন একই এলাকার রুহুল কুদ্দুস নামে একজন বৃদ্ধ কৃষক। নদী ভাঙন নিয়ে এই প্রতিবেদক কথা বলতে চাইলে কেঁদে ফেলেন। বলেন, ‌‘এখন এখানে নদীর কিনারে যার যা জায়গা জমি ছিল শেষ হয়ে গেছে। এখন আমাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখানের মানুষ যাবে কোথায়? কারও সঙ্গে আর কারও দেখা হবে না। আজ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চার কিলোমিটার নদী ভেঙে চলে আসছে। এখানে এখন বিদ্যুৎ লাইন, সামনে উত্তরবঙ্গের সড়ক, এটাও থাকবে না। সরকারের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।’ 

একই এলাকার মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমাদের এখানে গত শুক্রবার থেকে ভাঙনটা লেগেছে। এর আগেও বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাঁধের কাজটা সেভাবে মানসম্মত না হওয়ায় কারণে আবার নদীর গর্ভে চলে গেছে। এখান থেকে নদীর দূরত্ব ছিল তিন কিলোমিটার। সেই নদী ভাঙতে ভাঙতে ৩০ মিটারও আর নেই। এলাকার বাড়িঘরে যা জিনিসপত্র ছিল সব নিয়ে চলে গেছে।’

স্থানীয় সাহেবনগর জামে উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক আবু আনসারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে মাদ্রাসা থেকে যতটুকু নদী দেখা যাচ্ছে এটা যদি কিলোমিটার হিসাব করা যায়, ১০০ মিটার হতে পারে। এই ১০০ মিটার ভাঙলেই আমরা দেখতে পাবো আমাদের মাদ্রাসা পদ্মা নদীতে চলে গেছে। এখন মাদ্রাসায় প্রায় সাড়ে ৬০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। এ ছাড়া ৩২ জন শিক্ষক আছেন। আমরা এখানে দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানাই।’ 

বিশেষ করে ভাঙনের শিকার হয়েছে তালবাড়িয়ার বারুইপাড়া, খাদিমপুর, সাহেবনগর, মির্জানগর ও ঘোড়ামারাসহ বেশ কিছু এলাকা

কুষ্টিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (টেকনিক্যাল) মো. মোকসেমুল হাকিম বৃহস্পতিবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কুষ্টিয়া-পাবনা মহাসড়কের রানাখড়িয়া সাহেবনগরে পদ্মা নদীর পাশে পিএলসির ১৩২ কেভি টাওয়ার পোল ছিল। এটি বিপদজনক অবস্থায় ছিল। ভেড়ামারা থেকে রাজবাড়ীতে বিদ্যুৎ যেতো। বৃহস্পতিবার টাওয়ার পোল নদীগর্ভে চলে গেছে। এই লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে।’

কুষ্টিয়া  পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাহেবনগর ভাঙনকবলিত এলাকায় জিওব্যাগ ও টিউব ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘টানা বৃষ্টিতে নদীর পানি ২-৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ভাঙন তীব্র হয়েছে। আমরা ব্যাপারটি অবজারভেশনের মধ্যে রেখেছি। কয়েকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। বিদ্যুৎ সঞ্চালন টাওয়ার ও বেড়িবাঁধসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় সেখানে দ্রুত জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০০ মিটার গ্রোয়েন (বাঁধ) নদীর মধ্যে আছে। সেখানে পানি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অপর পাড়ে ভাঙছে। এমনটাই ধারণা করছেন এলাকাবাসী। যেহেতু নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে তাই ভাঙনটা তীব্র হচ্ছে।’

Source link

Related posts

মেয়র টুটুলের ওপেন হার্ট সার্জারি, টুঙ্গিপাড়াবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা

News Desk

চট্টগ্রামে ওসির ‌‘মসজিদ পুলিশিং’

News Desk

কারবারি ও ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা, তিন ছেলে গুরুতর আহত 

News Desk

Leave a Comment