‘গভীর রাতে বুকব্যথা ওঠার পরই প্রচণ্ডভাবে ঘামাচ্ছিলাম। মনে করেছিলাম গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা। কিন্তু কোনোভাবেই ব্যথা কমছিল না। স্বজনরা দ্রুত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হতে বললেন চিকিৎসক। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানালেন স্ট্রোক করেছি। বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে তিন দিনের বিশ্রাম দিলেন। আমার প্রয়োজন ছিল এনজিওগ্রাম করে হার্টে কোনও ব্লক আছে কিনা দেখে চিকিৎসা দেওয়ার। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা ছিল না এই হাসপাতালে। পরে চিকিৎসক আমাকে ঢাকায় পাঠান।’
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যবস্থার এমন বর্ণনা দিয়েছেন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাপারসন নারায়ণ সাহা। তিনি বরিশাল নগরীর বাসিন্দা।
নারায়ণ সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই হাসপাতালে হৃদরোগের কোনও ধরনের চিকিৎসা না পেয়ে স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য যাই। সেখানে গিয়ে পরীক্ষা করে হার্টে একটি ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসক রিং পরিয়ে দেন। ঢাকায় রিং পরানোর খরচের চেয়ে সবচেয়ে বেশি টাকা ব্যয় হয়েছে আসা-যাওয়া ও থাকা-খাওয়ায়। অথচ শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলে অল্প টাকায় হয়ে যেতো। শুধুমাত্র রিং পরানোর চিকিৎসক না থাকায় প্রায় এক বছর ধরে হাসপাতালে এনজিওগ্রাম কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
একই দুরবস্থার কথা জানালেন ওই হাসপাতালে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন মো. লিটু, বজলুর রহমান ও আসাদসহ একাধিক রোগী। হার্টের চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন তারা। কিন্তু চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে এনজিওগ্রাম এবং রিং পরানোর কার্যক্রম বন্ধ আছে। তাদের ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
মো. লিটু ও বজলুর রহমান জানিয়েছেন, চিকিৎসকরা ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন। কিন্তু তাতে যে খরচ হবে সে খরচ কোথা থেকে আসবে, তা তারা বলছেন না। এই হাসপাতালে এনজিওগ্রাম ও রিং পরানোর ব্যবস্থা থাকলে স্বল্প সময়ে অল্প খরচে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারতেন তারা। এখন খরচ জোগাতে জমি বিক্রি করতে হবে, নয়তো ধারদেনা করতে হবে। এ ছাড়া কোনও উপায় দেখছেন না তারা।
হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিনিয়র টেকনিশিয়ান গোলাম মোস্তফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৩ সালে হৃদরোগ বিভাগে প্রায় ৯ কোটি টাকার এনজিওগ্রাম মেশিন সরবরাহ করেছিল সরকার। কিন্তু মেশিনটি পরিচালনায় চিকিৎসক না থাকায় দীর্ঘদিন রোগীদের কোনও উপকারে আসেনি। পরবর্তীতে ইন্টারভেনশনাল হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম সালেহ উদ্দীনকে বরিশালে পদায়ন করা হলে মেশিনটির কার্যক্রম শুরু করেন। ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই থেকে তিনি রোগীদের হার্টে রিং পরানো শুরু করেন। সেই থেকে কার্যক্রম সচল ছিল। রোগীদের শুধু রিং কিনতে হতো। এ ছাড়া আর কোনও খরচ দিতে হতো না।’
ডা. সালেহ উদ্দীন এনজিওপ্লাস্টি করার পাশাপাশি হৃৎপিণ্ড ও কিডনিতে রিং সংযোজন করতেন উল্লেখ করে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘তার কাছে বহু রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ আছেন। গত ২৬ নভেম্বর ডা. সালেহ উদ্দীনকে সহকারী অধ্যাপক পদ থেকে সহযোগী অধ্যাপক করে পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। তিনি সেখানে চলে গেলে স্থবির হয়ে পড়ে শের-ই-বাংলা হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ।’
হাসপাতালের সিসিইউতে ১৬টি সিটের বিপরীতে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক রোগী ভর্তি থাকেন জানিয়ে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘যাদের বেশিরভাগের হার্টে এনজিওগ্রাম করা জরুরি। এজন্য কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর তাদের ঢাকায় পাঠানো হয়। এদের মধ্যে যারা টাকা জোগাড় করতে পারেন তারা ঢাকায় যান। আর যাদের সামর্থ্য থাকে না তারা ওষুধ খেয়ে ব্যথা নিরাময়ের চেষ্টা করেন। অনেকে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যান।’
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক এক সহযোগী অধ্যাপক হার্টের রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। এ ছাড়া হাসপাতালের জুনিয়র ১১ জন চিকিৎসক কার্ডিওলজি বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন। রিং পরানোর চিকিৎসক নেই এখানে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিভাগের ছয় জেলাসহ পদ্মা সেতুর এপারের ১১ জেলাবাসীর চিকিৎসার আশ্রয়স্থল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এ কারণে ঢাকায় না গিয়ে সবাই চিকিৎসার জন্য চলে আসেন। কিন্তু রিং পরানোর কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর থেকে বিপাকে পড়েছেন রোগীরা।
এ ব্যাপারে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এইচ এম সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডা. সালেহ উদ্দীন থাকাকালীন হাসপাতালে এনজিওগ্রাম থেকে শুরু করে হার্টে রিং বসানোর কাজ হতো। স্বল্প খরচে তা হয়ে যেতো। কিন্তু তার বদলির পর ওই পদ শূন্য। তার মতো অভিজ্ঞ চিকিৎসক না পাওয়ায় এনজিওগ্রাম থেকে শুরু করে হার্টে রিং বসানো বন্ধ রয়েছে। এমনকি ওই বিভাগের টেকনিশিয়ান গোলাম মোস্তফা অবসরে যাওয়ার পরও তাকে ধরে রাখা হয়েছে। যাতে অভিজ্ঞ চিকিৎসক আসার পর কোনোভাবে রোগীদের সমস্যায় পড়তে না হয়। আমার তরফ থেকেও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি। মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। এখন মন্ত্রণালয় চিকিৎসক দিলেই যেকোনো সময় কার্যক্রম শুরু করা যাবে।’
প্রসঙ্গত, ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্ব সহকারে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘ইয়েস, ইউজ হার্ট ফর অ্যাকশন’ অর্থাৎ ‘হৃদয় দিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।’
হার্টের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে মিলে বিশ্ব হার্ট ফেডারেশন ১৯৯৯ সাল থেকে প্রতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়।
স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে দুই লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যার ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী তামাক। এ ছাড়া হৃদরোগে মৃত্যুর ২৫ শতাংশের পেছনে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে বছরে ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বিশ্বে বছরে ১৯ লাখ মানুষ তামাকের কারণে হৃদরোগে মারা যায়। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯-এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করছে, যা হৃদরোগ পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলছে।