চলতি শুষ্ক মৌসুমে ফরিদপুরের পদ্মা নদীতে আবারও নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। নদীর মাঝে জেগে ওঠা ছোট-বড় অসংখ্য ডুবোচরের কারণে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো ও বড় ট্রলার চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা এসব পণ্যবাহী জাহাজ সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দরে ভিড়তে পারছে না। এতে অচল হতে বসেছে জেলার একমাত্র নৌবন্দর হিসেবে পরিচিত সিঅ্যান্ডবি ঘাটটি।

এদিকে পণ্যবাহী নৌযান ভিড়তে না পারায় নৌবন্দরের শুল্ক আদায়ও কমে গেছে। এছাড়াও এসব নৌযান থেকে পণ্য খালাস করতে অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। পণ্যবাহী নৌযানের মালিকরা ও পণ্য আমদানিকারকরাও পড়েছেন চরম বিপাকে, নৌবন্দরের শ্রমিকরাও বেকার হতে বসেছেন। এছাড়া দিনের পর দিন অরক্ষিত স্থানে জাহাজ, কার্গোগুলো থাকায় পড়তে হচ্ছে বিবিধ সমস্যায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত দুই মাস আগে থেকে পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করে। তখন থেকেই এসব নৌযানগুলো নাব্যতা সংকটের কবলে পড়ে সিঅ্যান্ডবি ঘাটের বন্দরে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে এই দূরবস্থা চরমে পৌঁছেছে। নাব্যতা সংকট সমাধানে কয়েকটি স্থানে বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজার মেশিন বসিয়ে খনন কাজ করছে। তবে খননের কয়েকদিনের মধ্যেই আবার বালু এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে, ফলে সুফল মিলছে না। 

দক্ষিণবঙ্গসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্যবসায়িক পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নৌবন্দরটি শত বছরের প্রাচীন। ২০১৭ সালে সরকার এটিকে তৃতীয় শ্রেণির নৌবন্দরে অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নৌ পথে এই বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করা হয়।

ফরিদপুরের সোনালি আঁশ খ্যাত পাট এই বন্দর হয়েই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহির্বিশ্বে রফতানি হয়। এছাড়াও সিলেট থেকে কয়লা ও বালু, ভারতের গরু ও চালসহ চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মিরকাদিম থেকে এই নৌপথেই চাল আমদানি হয়। নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকে প্রচুর সিমেন্টবাহী জাহাজ ও কার্গো এই বন্দর থেকে খালাস করা হয়। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, নৌবন্দরে ভিড়তে না পেরে অনেক দূরে দিঘীর চর, ভুঁইয়াবাড়ি ঘাট, খুশির বাজার, বাইল্যা হাটা, হাজিগঞ্জের চর, চরভদ্রাসনের এমপিডাঙ্গি ও গোপালপুরসহ বিভিন্ন স্থানে নদীর তীরে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো ও বড় ট্রলার ভেড়ানো রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাট থেকে আসা সিমেন্টবাহী জাহাজের মাস্টার শহিদ শেখ বলেন, চরভদ্রাসনে এসে ঠেকে গেছি। আমার জাহাজে ১২ হাজার বস্তা সিমেন্ট আনা যায়। কিন্তু পর্যাপ্ত গভীরতা নেই বলে আট হাজার বস্তা আনতে হয়েছে। এতে পণ্যের ভাড়াও কমে গেছে আমাদের। নৌবন্দরে ভিড়তে পারলে সম্পূর্ন টাকা পেতাম। কিন্তু এখন এই ভাড়ার অর্ধেক দিয়ে আরেকটি ট্রলার ভাড়া করে মাল খালাস করতে হচ্ছে। এসব কারণে আমাদের স্টাফ খরচ এবং অন্যান্য ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এছাড়া জানমালের নিরাপত্তা নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন।

আরেকটি জাহাজের মাস্টার আসলাম হোসেন বলেন, নাব্যতা সংকটে জাহাজের ইঞ্জিনের পাখা ভেঙে যায়, সুখান আটকে যায়। জাহাজের অনেক ক্ষতি হয়।

তিনি আরও বলেন, নদীতে অন্তত ১০ হাত গভীর পানি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে কোথাও কোথাও দুই-তিন হাত পানি রয়েছে।

ড্রেজিংয়ের পরও নদীর নাব্যতা সংকট না কমার কারণ জানতে চাইলে ড্রেজিংয়ের কাজে নিযুক্তরা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, ড্রেজিংয়ের পরপরই আবার নতুন বালু এসে ভরে যাচ্ছে, এতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। 

বন্দরের ব্যবসায়ী রাশেদ হোসেন বলেন, দক্ষিণবঙ্গসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্যবসায়িক পণ্য আনা নেওয়ার জন্য এই নৌবন্দরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বছরের পাঁচ মাসের মতো সময় এখানে পানি কম থাকে বিধায় বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতা সৃষ্টি হয়।

নৌ বন্দরে কর্মরত শ্রমিক সেলিম হোসেন বলেন, কার্গো জাহাজ বন্দরে না ভিড়তে পারায় আমাদের মাল নামানোর কাজ কমে গেছে। নাব্য সংকটের কারণে আগের মতো এখন আর বন্দরে বড় জাহাজ আসে না। শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই বেকার হয়ে গেছে। কাজ কমে যাওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিনতিপাত করছেন তারা। 

ফরিদপুর নৌবন্দরের পণ্য খালাসে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার আকরাম হোসেন বলেন, হাজারো শ্রমিক এই নৌবন্দরে কাজ করেন। এর মধ্যে অনেক ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীও রয়েছেন। জাহাজ ও কার্গো না আসায় তাদের কাজ কমে গেছে।

নৌবন্দরটি ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নে অবস্থিত। ডিক্রিরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান মিন্টু বলেন, নাব্যতা সংকটে বন্দরটি অচল হতে বসেছে। বন্দরটিকে ঘিরে হাজার হাজার শ্রমিক-ব্যবসায়ীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল। বন্দরটি অচল হলে শ্রমিকরা কাজ হারাবে, বাড়বে চুরি-ছিনতাই।

বিআইডব্লিউটিএর (আরিচা নৌ বন্দর) উপ-পরিচালক শাহ আলম বলেন, নৌবন্দরটিকে সচল করতে নৌচ্যানেলে ড্রেজিংয়ের কাজ চলছে। নৌবন্দরের সম্মুখ অংশে কোনও নাব্যতা সংকট নেই, কিন্তু নদীর মাঝে বেশ কিছু স্থানে চর জেগেছে। ওই সব এলাকায় ড্রেজিং চলমান রয়েছে।

 

 

Source link

Related posts

সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই, হারিয়ে যাচ্ছে ২০০ বছরের পুরনো নীলকুঠি

News Desk

পূজামণ্ডপে অঘটন ঘটানো সেই ইকবাল কোথায়?

News Desk

মামলা করে কী করমু, বিচার পামু না: ঢাকায় সমাবেশে নিহত রেজাউলের বাবা

News Desk

Leave a Comment