নানা সংকটে হুমকিতে বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরী
বাংলাদেশ

নানা সংকটে হুমকিতে বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরী

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রফতানি ও দেশের রাজস্ব খাতে অবদান রাখা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্পনগরী বর্তমানে নানা সংকটে হুমকির মুখে পড়েছে। পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যায় লোকসানের মুখে এখানকার অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান। ড্রেনেজ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, নিরাপত্তাহীনতাসহ নানাবিধ কারণে এখানে বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেক উদ্যোক্তা। উৎপাদনমুখী এ শিল্পনগরীতে শিল্প খাতে প্লট বরাদ্দ না দিয়ে টাকার বিনিময়ে বড় কোম্পানিগুলোকে মালামাল গুদামজাত করার জন্য ভাড়া দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৮৬ সালে নোয়াখালীর চৌমুহনী শহরের চৌরাস্তার উত্তরে ২৫ একর ভূমির ওপর গড়ে তোলা হয় বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরী। সেই সময় মাটি ভরাটের জন্য বিসিকের বাইরে থেকে মাটি আনার কথা থাকলেও শিল্পনগরীর মধ্যস্থলে প্রায় ১০ একর ভূমিতে পুকুর কেটে ভরাট করা হয় নগরীর অভ্যন্তরে। এতে শিল্পনগরীর পরিধি ১০ একর কমে যায়। পরে সেই পুকুর ভরাটের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

শিল্প উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে বাকি ১৫ একর ভূমি ১৩৩টি প্লটে ভাগ করে স্বল্পমূল্যে ৮১টি কারখানার অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়। যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিক্যাল, টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, প্রিন্টিং প্রেস, খাদ্যসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির উৎপাদন করা হতো। এই শিল্পনগরীর বড় একটি প্রতিষ্ঠান গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস। এই প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত ওষুধ দেশের বাজারে বিক্রির পাশাপাশি মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কায় রফতানি হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।

এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোর আরেকটি দেশের বৃহত্তম ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের সঞ্চালন লাইনের যন্ত্রাংশ, চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, আন্ধারমানিক নদীতে ৬৬৭ মিটার দীর্ঘ সেতুতে ব্যবহৃত ধাতব অংশ ও বাংলাদেশ রেলওয়ের বোল্ট, স্লিপার ও নাটসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির এই কারখানায়।

বিসিক কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, সম্ভাবনাময় এই শিল্প নগরী থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮৮ কোটি ৯২ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১৮ কোটি ৮৫ লাখ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৫২ কোটি ৭৩ লাখ টাকার পণ্য উৎপাদন করা হয়েছে। যা চাহিদা অনুযায়ী দেশ-বিদেশে সরবরাহ করা হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নানা সুযোগ-সুবিধার হাতছানির বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরী বিদ্যুৎ ও পানি সংকটে ক্রমশ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখানে নিজস্ব পানি সরবরাহের কোনও ব্যবস্থা নেই। দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকে না। ড্রেনেজ সিস্টেম সঠিকভাবে না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটুপানি জমে। বিসিকের ভেতরে চারপাশে বসেছে অনুমোদনহীন চা-সিগারেটের দোকান। নগরীর নিরাপত্তায় নেই কোনও প্রহরী। ফলে দিনের অধিকাংশ সময় অফিস বাউন্ডারির ভেতর বসে বখাটেদের আড্ডা। মাদকের অবাধ বেচাকেনাও চলে এখানে। নারী শ্রমিকদের আতঙ্কে রাস্তা পার হতে হয়। অধিকাংশ সময় যৌন হয়রানি ও হেনস্তার শিকার হলেও ভয়ে কোনও প্রতিবাদ করার সাহস পান না।

বাইরে থেকে পানি কিনে এনে তা দিয়ে পণ্য উৎপাদন কাজ করায় উদ্যোক্তাদের গুনতে হয় বাড়তি খরচ। এ ছাড়া বিসিকের বিভিন্ন প্লটে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর গুদাম হিসেবে ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এতে হতাশ হয়ে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এ শিল্প নগরী থেকে। নানা সমস্যায় বর্তমানে ৯টি শিল্প কারখানা বন্ধ রয়েছে।

নানা সংকটে হুমকিতে বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরী

শিল্পনগরীতে থাকা মিতালী ফ্লাওয়ার মিলের কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, বিদ্যুতের ভেলকিবাজিতে আমরা অতিষ্ঠ। বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের উৎপাদন বন্ধ থাকে। কাজ চলুক বা না চলুক কর্মচারীদের দৈনিক হাজিরার টাকা দিতে হয়। জেনারেটর চালালে উৎপাদন খরচ অনেক বাড়তি হয়। তাছাড়া ভেতরে পানির ব্যবস্থা না থাকায় কিনে ব্যবহার করতে হয়। শ্রমিকদের গোসল থেকে ব্যবহার সব পানি বাইরে থেকে কিনে আনা লাগে। এতে ব্যয় কয়েকগুণ বেশি বেড়ে যায়।

অ্যালুমিনিয়াম কারখানার স্বত্বাধিকারী নিজাম উদ্দিন বলেন, আমাদের পানি সরবরাহ করতে পারছেন না দীর্ঘ বছর থেকে। নেই কোনও ড্রেনেজ সিস্টেম। বর্ষায় আমাদের কারখানার ভেতরে পানি জমে যায়। হাঁটার রাস্তা থাকে না। আমাদের উৎপাদনের জন্য পানি বাহিরে থেকে কিনে আনা লাগে। এতে আমাদের পণ্যের দামও বাড়তি হয়। বাজারে অন্যরা কম দামে দিতে পারলেও আমরা তা পারি না। ফলে আমাদের বাজার নষ্ট হয়। অচিরেই আমরা এর সমাধান চাই।

গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসে কর্মরত এক নারী শ্রমিক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, আমরা ফ্যাক্টরিতে কাজে আসা যাওয়ার সময় মূল গেইটে বিসিক অফিসের ভেতরের বাগান থেকে বখাটেরা হয়রানি করে, খারাপ কথা বলে। আমরা পেটের দায়ে এখানে কাজ করি। ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারি না। বললে যদি পরে কোনও ক্ষতি করে বসে। প্রতিদিনই দেখি সেখানে নানা বয়সী লোকজন নেশা করে। এ নিয়ে আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকি।

বেগমগঞ্জ শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটি একটি সম্ভাবনাময় শিল্পনগরী। এর পাশ দিয়ে ঢাকা-নোয়াখালী হাইওয়ে সড়ক। এটার যোগাযোগব্যবস্থা ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উদ্যোক্তাদের পছন্দের জায়গা এটি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নানাবিধ সমস্যার কারণে এখান থেকে অনেক উদ্যোক্তা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এই নগরীর ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিকমতো না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতে এখানে পানি জমে। এখানে নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা নেই। এখানে বিদ্যুৎ সমস্যা অনবরত লেগেই আছে। পানির কোনও ব্যবস্থা নেই। পানির একটি টাংকি থাকলেও তা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বহু বছর ধরে। পরিত্যক্ত টাংকি সংস্কারের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

নানা সংকটে হুমকিতে বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরী

তিনি আরও বলেন, বিসিক অফিসের সামনে বখাটেদের আড্ডা নগরীর জন্য হুমকিস্বরূপ। এখানে কোনও নিরাপত্তা প্রহরী নেই। থানা পুলিশ টহল দিলেও তা নিয়মিত হয় না। সাম্প্রতিককালে বিসিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এখানে গোডাউন ও আইসক্রিম ডিপো ভাড়া দিয়েছে যেটি দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আমরা এসব বিষয়ে একাধিকবার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা কালক্ষেপণ করেও কোনও সমাধান দিকে পারেনি। আমরা অচিরেই এর সমাধান চাই।

অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিক নোয়াখালী জেলা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. মুনতাসির মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ড্রেনেজ সিস্টেমের সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এর সমাধান হবে। বিদ্যুতের বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। আর আমরা পানি দিতে পারছি না বলে কোন মালিক থেকে পানির বিল ও নিচ্ছি না। তারা চাইলে সামনে থাকা পুকুরের পানি ব্যবহার করতে পারছে। তবে তাদের পানির সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধানের জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নিরাপত্তার জন্য নিকটস্থ থানা পুলিশ টহল দিচ্ছে। এখানে চাইলেও শিল্প পুলিশের কাজ করার সুযোগ নেই। কারণ শিল্প পুলিশের ক্যাম্প দিতে হলে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি থাকে। তা আমাদের হাতে নেই। তাতেও যদি কেউ নিরাপত্তাহীনতায় থাকে টহল আরও জোরদারের জন্য আমরা থানায় অনুরোধ করবো।

অবৈধভাবে ডিপো ও গোডাউন ভাড়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি জানান, যারা এখনও অবৈধভাবে আছে তাদের আমরা বিভিন্ন সময় একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। তারা আমাদের চিঠির জবাব না দিলে আমরা অচিরেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।

 

Source link

Related posts

সিলেটে করোনায় আরো ৪ জনের মৃত্যু

News Desk

করোনায় দেশের অবস্থা খুবই খারাপ : সৈয়দ মাহমুদ হোসেন

News Desk

মোবাইল কোর্ট সরে গেলেই ১২০ টাকার পেঁয়াজ ২০০

News Desk

Leave a Comment