নববর্ষে কাতল মাছের মেলা, ক্রেতাদের ভিড়
বাংলাদেশ

নববর্ষে কাতল মাছের মেলা, ক্রেতাদের ভিড়

কাতল মাছে সেজেছে সারি সারি দোকান। কেউ পাল্লায় তুলছেন, কেউ দেখছেন। আবার পাশে বসে কেউ কাটছেন। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন সকালে কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে এ দৃশ্য দেখা যায়। মূল বাজার ছাড়িয়ে পুরোনো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে এই মাছের মেলা।

এই মেলা চলবে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত। মেলা ঘিরে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের ঢল নেমেছে রাজগঞ্জ বাজারে। রয়েছে উৎসুক জনতার ভিড়। অনেকে মানুষ কিনে কেটে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজগঞ্জ বাজারে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে কাতল মাছের মেলা বসে। এটি কুমিল্লার শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। মেলায় সারি সারি কাতল দেখে মুগ্ধ ক্রেতারা। বিকিকিনিও হয়েছে বেশ জমজমাট। এবারও রাজগঞ্জ বাজার ও এর আশপাশের সড়কে বসেছে মাছের মেলা। মূলত কাতল মাছের মেলা হলেও অন্যান্য মাছও পাওয়া যায়। এবার মেলায় মাছের ৮০ শতাংশই কাতল।

মেলা ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী এই মেলা শত বছরের বেশি সময় ধরে চলমান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা বড় কাতল মাছ নিয়ে এখানে হাজির হন। কেউ পানিতে রেখে জীবিত রেখে বিক্রি করেন। আকার ও ওজন অনুযায়ী দাম নির্ধারণ হয়। বৈশাখে অতিথি আপ্যায়ন ও স্বজনদের উপহার দেওয়া হয়। মেলা চলবে আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত।

পুঞ্জিকা অনুযায়ী, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বৈশাখের দ্বিতীয় দিন নববর্ষ পালন করেন। তাই দুই দিন মেলা চলবে। মেলা ঘিরে রাজগঞ্জ বাজার ও আশপাশের এলাকায় নানা শ্রেণির মানুষের ঢল নেমেছে। এতে করে মাছ বাজার ছাড়িয়ে মেলার বিস্তৃতি সড়ক ও গলিতে গিয়ে পৌঁছেছে। একদিকে রাজগঞ্জ মোড়, অন্যদিকে মোগলটুলির কুমিল্লা হাইস্কুলের প্রধান ফটক পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে সারি সারি মাছের ডালা নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। এর মধ্যে জীবিত ও মরা কাতল মাছও রয়েছে। জীবিত মাছের দাম বেশি। মরা মাছের দাম কিছুটা কম। দেশি মাছের চাহিদা বেশি, দামও বেশি। আজ মুসলমান লোকজনের উপস্থিতি বেশি ছিল।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দ্বিতীয় দিন অর্থ্যাৎ মঙ্গলবার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের উপস্থিতি বেশি হবে। আজ মুসলামদের সংখ্যা বেশি ছিল। পুঞ্জিকা অনুযায়ী, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পহেলা বৈশাখ পালন করবেন মঙ্গলবার। অতিথি আপ্যায়নের জন্য তারা বড় তাজা মাছ কেনেন। এদিনই রান্না করেন তারা। 

মূল বাজার ছাড়িয়ে পুরোনো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে এই মাছের মেলা

মাছ ব্যবসায়ী দেবিদ্বার উপজেলার ইউসুফপুর এলাকার রবিউল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেবিদ্বার, ব্রাহ্মণপাড়া এলাকা থেকে পালা মাছ এনেছি মেলায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ও আখাউড়া, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, যশোর থেকেও ব্যবসায়ীরা মাছ এনেছেন। অন্যান্য বারের মতো এবারও মেলা জমেছে। তবে মাছের দাম এবার তুলনামূলক কম। এর মধ্যে দেশি মাছের দাম বেশি।’

বড় একটি কাতল হাতে নিয়ে তিনি বলেন, ‘যেগুলোর ওজন চার-পাঁচ কেজি, সেগুলোর কেজি ৪০০-৪৫০ পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। তবে বাজার বুঝে দাম ওঠানামা করে। আট-১০ কেজি ওজনের মাছগুলোর কেজি ৫৫০-৬০০ পর্যন্ত বিক্রি করছি। যেহেতু এটি কাতল মাছের মেলা তাই কাতলই বেশি। অন্য মাছ কম।’

চান্দিনা সদর থেকে আসা শ্যামল দাস নেচেগেয়ে মাছ বিক্রি করেছেন। জলের দামে সরবত, দেশি দেশি, নিয়া যান বলে দাম বলছেন। তিনি বলেন, ‘মাছ ব্যবসায়ীদের বৈশাখ বাজারেই কাটে। এখানে মাছ বিক্রি করেই তারা বৈশাখের আনন্দ খুঁজে পান। পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বেশি থাকায় মাছের দাম বেড়ে যায়। মেলায় অনেকে বড় মাছ দেখতে আসেন। কিন্তু সবাই কেনেন না। তবে কোনও মাছ থেকে যায় না।’

এই মেলা চলবে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত। মেলা ঘিরে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের ঢল নেমেছে রাজগঞ্জ বাজারে

আরেক বিক্রেতারা আবুল হাশেম বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ৩০০ মাছ বিক্রেতা এসেছেন। আকার ও ওজন অনুযায়ী মাছের দরদাম নির্ধারিত হয়। এবারের মেলায় ১২ কেজি ওজনের কাতল মাছ ৮৫০-৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। ১০ কেজির রুই মাছ বিক্রি করেছি ৭৫০-৮০০ টাকা কেজি দরে।’

মাছ কিনতে আসা চান্দিনা উপজেলার ইকরামুজ্জমান শান্ত বলেন, ‘৩০ কিলোমিটার দূর থেকে মাকে নিয়ে মেলায় এসেছি। মায়ের পছন্দের সবচেয়ে বড় মাছটা কিনেছি।’

কুমিল্লা নগরের বাসিন্দা একেএম আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘ছোটবেলায় দাদার সঙ্গে আসতাম এই বাজারের মেলায়। বাবার সঙ্গেও এসেছি বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে। তখনকার বাজার আরও ছোট ছিল। তবে মাছ ছিল আরও বড়। দামও কম ছিল। গত দুই দশকে বাজার বড় হয়েছে। সেইসঙ্গে মাছের দামও বেড়েছে।’ 

বাজারে রয়েছে উৎসুক জনতার ভিড়। অনেকে মানুষ কিনে কেটে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন

এই মাছের মেলা ঐতিহ্যের অংশ বলে জানালেন কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর। তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই মেলা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল সেটি নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে মেলার বয়স শত বছরের বেশি এবং এটি কুমিল্লার ঐতিহ্য। মেলা থেকে বড় মাছ কিনে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় পাঠানো হয় এবং অনেকে মেলার মাছ দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করেন। এই মেলায় একসময় শুধুই কাতল মাছ উঠতো। এখন অন্যান্য মাছও আসে; তবে অধিকাংশই কাতল মাছ। বিক্রিও হয় বেশ।’

কুমিল্লার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অনিমা মজুমদার বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রাজগঞ্জ বাজারে কাতল মাছের মেলা হয়। এটি মাছে ভাতে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই অংশ। অনেকে অতিথিদের কাতল মাছ উপহার দেন। অতিথি আপ্যায়ন করেন।’

Source link

Related posts

গুমের তথ্য জাতিসংঘের যাচাই করা উচিত

News Desk

৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, তিন বছরে অগ্রগতি ১০ শতাংশ

News Desk

তক্ষক, সাপের বিষ পাচার করতেন আকুল

News Desk

Leave a Comment