দোকানদার ছাড়াই এক দশক ধরে চলছে দোকান
বাংলাদেশ

দোকানদার ছাড়াই এক দশক ধরে চলছে দোকান

মানুষ নিজের জান-মালের সুরক্ষায় কী না করেন; নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে তালা-চাবি, সুউচ্চ প্রাচীর, দুর্ভেদ্য বেষ্টনী, আধুনিক সিসি ক্যামেরাসহ উন্নত সব প্রযুক্তির ব্যবহার করেন। যেন অবিশ্বাস জেঁকে বসা এই সময়ে ব্যক্তি থেকে সমাজ কেউ কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। তবে এত সব অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার ভিড়ে বিশ্বাসের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন হামিদুর রহমান শিপন নামে এক ব্যক্তি। টানা প্রায় ১০ বছর ধরে দোকানদার ছাড়াই চলছে শিপনের দোকান। অবিশ্বাস্য হলে সত্য, সকাল থেকে রাত অবধি দোকানদারহীন এই দোকানে কখনও চুরির ঘটনাও ঘটেনি। 

কুষ্টিয়ার কুমারখালী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শিপন গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমধর্মী এই দোকান, নাম দিয়েছেন ‘ভিন্ন রকম দোকান’। নামের মতোই ভিন্নতা আছে দোকানের বেচাকেনাতেও। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই দোকানে কোনও দোকানি নেই, কোনও নিরাপত্তাকর্মীও নেই। প্রতিটি পণ্যের গায়ে দাম লেখা আছে। ক্রেতারা পছন্দসই পণ্য কিনে ক্যাশ বাক্সে দাম পরিশোধ করে চলে যান। উদ্যোক্তা শিপন জানিয়েছেন, পণ্য নিয়ে কেউ মূল্য পরিশোধ করেননি; এমন ঘটনাও ঘটেনি কখনও। দোকানি নেই জানা সত্ত্বেও সেখানে কোনও দিন চুরি হয়নি, প্রায় ১০ বছর ধরে এভাবেই চলছে দোকানটি।

কুমারখালী পৌরসভার কাজিপাড়া এলাকার হামিদুর রহমান শিপন দোকানটির মালিক। তিনি পেশায় একজন হকার। কখনও বাসে, কখনও ট্রেনে আবার কখনও আবার মার্কেটে ঘুরে ঘুরে গামছা, রুমাল, লুঙ্গি ও শাড়ি বিক্রি করেন। 

সম্প্রতি দোকানটিতে গিয়ে দেখা যায়, দোকানের সামনেই ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে রুমাল। প্রতিটি রুমালের গায়ে দাম লেখা রয়েছে। এ ছাড়াও ছোট এই দোকানে থরে থরে সাজানো রয়েছে গামছা, তোয়ালে, থ্রি-পিস, শাড়ি, টি-শার্ট, ছোটদের জামাকাপড় ও মোজাসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী। তবে নেই কোনও দোকানি। ছোট এই দোকানটির জন্য প্রতি মাসে ৬০০ টাকা ভাড়া গুনতে হয় শিপনকে। 

ভিন্ন রকম এই উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. হামিদুর রহমান শিপন বলেন, ‘আমি একজন হকার। শুধু দোকানে বসে থাকলে আমার সংসারের খরচ জোগাড় করতে পারবো না। তাই বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে গামছা, তোয়ালে ও রুমাল বিক্রি করে বেড়াই। একইসঙ্গে দোকানও চলছে। ক্রেতারা দোকানে এসে পণ্য পছন্দ হলে সেটার মূল্য তালিকা দেখে দোকানের সামনে ঝুলিয়ে রাখা বাক্সে টাকা পরিশোধ করে চলে যান। 

দোকানে কখনও চুরি হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে শিপন বলেন, ‘চুরি হওয়া নিয়ে আমি চিন্তা করি না। আমি মানুষকে বিশ্বাস করি। আর বিশ্বাসের ওপরেই দোকান করেছি। নিজেকে বিশ্বাস করি বলে মানুষের ভালোবাসা নেওয়ার জন্য আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরি। প্রায় ১০ বছর ধরে এভাবেই চলছে। দোকান থেকে দৈনিক ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়। প্রতিদিন সকাল ৯টায় দোকান খুলে রাত ১১টায় বন্ধ করি।’ 

শিপন বলেন, ‘অভাবের কারণে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে ছেলেমেয়েদের শত কষ্টের মধ্যেও পড়ালেখা করাচ্ছি। দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে বড় মেয়েটি পাংশা কলেজে স্নাতক পড়ছে। ছেলেটা সপ্তম শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়েটা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, পড়াশোনার খরচ চালানো অনেক কঠিন। 

কুষ্টিয়ার কুমারখালী স্টেশনের প্লাটফর্মে শিপন গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমধর্মী এই দোকান

শিপন আরও বলেন, ‘ভিন্ন রকম দোকানের পাশাপাশি আমি স্টেশনে ট্রেনযাত্রীদের বিনামূল্যে পানি পান করাই। মানুষকে পানি পান করানোর জন্য ১৮০০ টাকা জমিয়ে একটা ফিল্টারও কিনেছি।’

যেসব অসুস্থ রোগী ট্রেনে উঠতে পারেন না, তাদের ওঠার ব্যবস্থা করে দেন বলেও জানান শিপন। এ ছাড়াও রুমাল বিক্রির টাকা জমিয়ে যাত্রীদের জন্য স্টেশনে দুটি ফ্যান কিনে দিয়েছেন এই যুবক। তিনি জানান, এই এলাকায় কেউ মারা গেলে বিনামূল্যে সেটির প্রচারেরও ব্যবস্থা করেন তিনি।

বিভিন্ন সেবামূলক কাজের জন্য শিপনের প্রশংসা করলেন স্থানীয়রাও। দোকানে পণ্য দেখছিলেন রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘এখনকার সময় যেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এত এত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়, সেখানে দোকাদারহীন দোকান অবিশ্বাস্য বলা চলে। এই দোকানের একটা পণ্য কিনতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে। আরও একটি গর্বের বিষয়—এমন একটা ব্যতিক্রমী দোকান আমাদের কুষ্টিয়ায় আছে; এটি অনেক আনন্দের।’

Source link

Related posts

এমপিওভুক্তিতে নানা জটিলতায় অনেক শিক্ষক, ফের সুপারিশের দাবি

News Desk

খুলনা ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৩৫ জনের মৃত্যু

News Desk

আজ ঈদ উদযাপন করেছেন নোয়াখালীর কিছু মানুষ

News Desk

Leave a Comment