এবারের বন্যায় দুমড়ে মুচড়ে গেছে কুমিল্লা। ভেঙে পড়েছে জেলার ৮ উপজেলার অর্থনীতির চালিকা ও অবকাঠামো। প্লাবিত হয়েছে কৃষিজমি, মাছের ঘের, ভেঙে গেছে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি। এসব খাতে তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ২০ আগস্ট ভারতীয় ঢলের পানি ও অতিবৃষ্টিতে কুমিল্লায় আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। এতে ডুবে যায় ঘরবাড়ি, গরুর খামার, মুরগির খামার, মাছের ঘের, পুকুর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাটসহ প্রায় সব কিছু। বন্যায় কুমিল্লায় তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষতি আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কুমিল্লার ১৪ উপজেলা প্লাবিত হলেও ৮ উপজেলার অবস্থা ভয়াবহ। সেগুলো হলো- বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট ও বরুড়া উপজেলা।
মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, এসব উপজেলায় ২১ হাজার ৩০৯টি পুকুর, দীঘি ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ৩৩৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় ৬০ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
নাঙ্গলকোট উপজেলার উদ্যোক্তা জহিরুল আলম বলেন, ক্ষতির কথা বলে কী লাভ হবে? শেষ সম্বল দিয়ে প্রায় ৫ লাখ টাকা ব্যয় করে মাছ বড় করিয়েছি। মাছগুলো ১ থেকে ৪ কেজি পর্যন্ত বড় হয়েছিল। কদিন পরই বিক্রির চিন্তা ছিল। এর আগেই আমার সব শেষ হয়ে গেলো। এটিই ছিল একমাত্র সম্বল। আমাদের কী হবে? সরকার যদি সুদৃষ্টি না দেয় আমাদের আর উপায় থাকবে না। পথে বসতে হবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বেলাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এখনও ক্ষতির পরিমাণ কতো তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা উপজেলার তথ্য মতে ৩৩৩ কোটি ২৮ লাখ টাকার ক্ষতির একটি পরিমাণ দাঁড় করিয়েছি। কুমিল্লায় মৎস্যখাত সারা দেশে অবদান রেখে যাচ্ছে বিগত কয়েক বছর। এই অঞ্চলের মৎস্যখাত ক্ষতিগ্রস্ত মানে তা ছোট আকারে হওয়ার কথা নয়। শয়ে শয়ে ঘের ডুবে মাছ চলে গেছে।
তিনি আরও বলেন, যারা মোটা অঙ্কের টাকা লোন নিয়ে চাষ করেছে, তাদের সুদ কমানোর জন্য আমরা সুপারিশ করবো। এ ছাড়াও যারা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে যারা মাছ চাষ করতে চান তাদের ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। গ্রামে গ্রামে চাষিদের বিনামূল্যে মাছের পোনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। আশা করি এতে চাষিরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে জেলাজুড়ে কৃষিতে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। জানা গেছে, রোপা আমনের বীজতলা, রোপা আমন, শাক-সবজি, রোপা আউশ, রোপা আমন ও আখের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। কুমিল্লা জেলায় আবাদ করা জমির পরিমাণ এক লাখ ৩৫ হাজার ২৩৮ হেক্টর। যার মধ্যে ৬৩ হাজার ৯৭৪ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা টাকার অঙ্কে ৮৪৮ কোটি ২১ লাখ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কুমিল্লার উপ-পরিচালক আইউব মাহমুদ বলেন, কুমিল্লা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কুমিল্লার ক্ষতি হওয়া মানে সারা দেশে এর প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া প্রচুর কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। আমরা এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি প্রণোদনা, বিনামূল্যে সার ও বীজ বিতরণ,ক্ষুদ্র ঋণ নেওয়ায় সহায়তা, বিনামূল্যে কৃষিসেবা ও সার্বিক সহযোগিতা করবো। আমাদের কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কৃষকদের বাঁচানোর জন্য যা করা দরকার আমরা তাই করবো।
কুমিল্লার ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলাগুলোর অনেকের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। অনেকের গোয়ালের গরু মারা গেছে। ঘরবাড়ি ভেঙেছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে নষ্ট হয়েছে। সরকারি অনেক অবকাঠামো বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাছের ঘের ভেসে গেছে, খামার ডুবে গেছে, কৃষিজমি শেষ হয়ে গেছে। এসব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি হতে পারে।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এখনও দুর্যোগ চলছে। নিশ্চিতভাবে কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে ক্ষতি আমাদের ধারনার থেকে বেশিও হতে পারে। এখনই নিশ্চিতভাবে আমরা কোনও পরিসংখ্যান করিনি। দুর্যোগ শেষ হলে আমরা পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে তা নিরূপণ করবো।