তালপাতার হাতপাখায় ঘুরছে দুই শতাধিক সংসারের চাকা
বাংলাদেশ

তালপাতার হাতপাখায় ঘুরছে দুই শতাধিক সংসারের চাকা

তালপাতার হাতপাখায় ঘুরছে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দুই শতাধিক পরিবারের জীবন-জীবিকা। প্রতি বছরের চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে এই পাখার চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু এ বছর তাপপ্রবাহ খুব বেশি দিন থাকায় ভাদ্র মাসেও চলেছে পাখা তৈরির কাজ। নিকলীর দামপাড়া গ্রামের নোয়ারহাটি, টেকপাড়া ও বর্মনপাড়ায় ঘরে ঘরে চলে পাখা তৈরির কাজ। এসব পাখা যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

দামপাড়া গ্রামের নোয়ারহাটি, টেকপাড়া ও বর্মনপাড়ায় সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রত্যেকের বাড়ির উঠানে দলবেঁধে হাতপাখা তৈরি করেন নারী-শিশুরা। 

পাখা তৈরির কারিগররা জানালেন, গরমের তিন-চার মাসের পাখার বাজার ঘিরে পুরো বছরই ব্যস্ত থাকেন নারী-শিশুরা। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার গরম স্থায়ী হয়েছে দীর্ঘদিন। সঙ্গে লোডশেডিং বেশি থাকায় পাখার চাহিদা বেশি। সারাদেশ থেকে অর্ডার আসছে। এজন্য এখনও পাখা তৈরি করছেন তারা।

যেভাবে তৈরি

কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমে তালপাতাগুলো শুকিয়ে নির্দিষ্ট মাপে কেটে নিতে হয়। তারপর বেতির মতো করে এগুলো দিয়ে বুনন করে ছাঁচ তৈরি করা হয়। চক্রাকার ছাঁচের চারদিকে জালি বেত ঘুরিয়ে এর ওপর প্লাস্টিকের রিবন পেঁচানো হয়। মোড়ল বাঁশ কেটে ফালি করে পাখার হাতল বানিয়ে নাইলন সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়। এরপর প্লাস্টিকের সরু পাইপ কেটে হাতলে চুঙি দেওয়া হয়। আর এভাবেই তৈরি হয় তালপাতার হাতপাখা।

দীর্ঘ ১০ বছর পাখা তৈরি করে সময় পার করেছেন নোয়ারহাটির মালতী রানী দাস। তিনি বলেন, ‘আমাদের কয়েকটি গ্রামের নারীরা অন্য কাজের পাশাপাশি এসব পাখা তৈরি করেন। আমরাই মূলত গ্রামে তালপাখা তৈরির কাজ করি। আর বাড়ির পুরুষরা পাখা তৈরির যাবতীয় সরঞ্জামের জোগান দেন। শুধু বাড়ির নারীরা নন, শিশুসন্তানরাও উঠানে বসে আমাদের সঙ্গে হাতপাখা তৈরির কাজে সহযোগিতা করে।’

৪০-৫০ বছর ধরে হাতপাখা তৈরি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৪০-৫০ বছর ধরে হাতপাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন দামপাড়া গ্রামের নোয়ারহাটি, টেকপাড়া ও বর্মনপাড়ার বাসিন্দারা। কেউ কেউ তিন পুরুষ ধরে এই পেশায় আছেন। বংশপরম্পরায় গ্রামের মানুষজন পাখা তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। বর্তমানে এই গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের প্রায় এক হাজার মানুষ তালপাতার হাতপাখা তৈরি করে সংসার চালাচ্ছেন।

এসব পাখা যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়

এই গ্রামের আরেক নারী আশুলতা রায়। জাতীয় পরিচয়পত্রের ত‌থ্য অনুযায়ী বর্তমানে তার বয়স ৮০ বছর। এখনও মনোযোগ দিয়ে তৈরি করছেন সুন্দর ও আকর্ষণীয় হাতপাখা। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই দামপাড়া গ্রামে তালপাখা বানানো শুরু হয়। বাড়িতে শখের বসে আমার শাশুড়ি স্বর্গীয় হেমলতা রায় প্রথমে তালপাতা দিয়ে পাখা বানানো শুরু করেছিলেন। তখন বাড়ির অতিথি সেবায় এই পাখা ব্যবহার করা হতো। এখন শাশুড়ি বেঁচে নেই। কিন্তু তার কর্ম বেঁচে আছে আমাদের দিয়ে। মূলত তার কাছ থেকেই গ্রামের অন্যরা তালপাতার হাতপাখা বানানো শিখেছেন।’

বেড়েছে খরচ

গ্রামের প্রবীণ নারীদের দেওয়া তথ্যমতে, দেশ স্বাধীনের পর একটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়তো আট আনা। বিক্রি হতো এক থেকে দেড় টাকা। এখন একটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ে ৫০ টাকা। বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। একসময় গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তখন গরমে হাতপাখাই ছিল মানুষের ভরসা। এখন বিদ্যুৎ-জেনারেটর-আইপিএসসহ নানা যান্ত্রিকতা বেড়েছে। তবে কমেনি হাতপাখার কদর। এখনও গ্রাম-শহর দুই জায়গাতেই হাতপাখার বাজার রয়েছে। এই বাজার ধরে রাখতে এখন নানা রঙের নকশা ও জরি ব্যবহার করা হয়। তাই পাখা তৈরিতে খরচ বেড়েছে। এই গ্রামের নারীরা একসময় আশপাশের বিভিন্ন বাজার ও মেলায় হাতপাখা বিক্রির জন্য নিয়ে যেতেন। এখন তা করতে হয় না। বিভিন্ন জায়গার পাইকাররা বাড়ি এসে নিয়ে যান। 

সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রত্যেকের বাড়ির উঠানে দলবেঁধে হাতপাখা তৈরি করেন নারী-শিশুরা

পেশা নিয়ে আছে শঙ্কা

তবে বিদ্যুতের পাখার ভিড়ে সারাদেশে ঐতিহ্যের হাতপাখা হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেও দামপাড়া গ্রামের তালপাতার হাতপাখা টিকে আছে। বাঁশ, বেত, তালপাতার দাম বেড়ে যাওয়ায় পাখা তৈরি করে এখন আর পোষাচ্ছে না তাদের। এ অবস্থায় সংসারে যেমন টান পড়েছে, সেইসঙ্গে পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা এ নিয়েও শঙ্কায় আছেন তারা।

এ বিষয়ে উইমেন্স কাউন্সিনের সভাপতি সেলিনা ইয়াছমিন কাকলী বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। তবে দামপাড়া গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের নারীরা যুগ যুগ ধরে শিল্পটিকে টিকিয়ে রেখেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখন পর্যন্ত পেশাটি তাদের জীবন-জীবিকার মূল উৎস। এই হস্তশিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে এসব নারীকে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি, তাদের পরিবারের সচ্ছলতা বজায় রাখতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া খুবই জরুরি। ঐতিহ্যবাহী এই হস্তশিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা সবসময় তাদের তাদের পাশে আছি।’

Source link

Related posts

লকডাউন শিথিলে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক

News Desk

কিশোরগঞ্জে শুরু হয়েছে ‘আল্পনায় বৈশাখ-১৪৩১’ উৎসব

News Desk

রাজশাহী ও রংপুরে ডাকা পরিবহন ধর্মঘট স্থগিত

News Desk

Leave a Comment