তিস্তা নদী থেকে অর্ধকিলোমিটার দূরের পাকা সড়কের উঁচু স্থানে বসে ভাত রান্না করছেন আকলিমা খাতুন ও তার ষাটোর্ধ্ব শাশুড়ি। গতকাল শনিবার তাদের বাড়িতে কোমরসমান পানি উঠেছে । চাল-ডাল ও সবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করছিলেন।
আমতলা এলাকায় সড়কের ওপর দিয়ে তীব্র স্রোত চলে যাচ্ছে তিস্তা নদীর দিকে। এই সড়কে সকালের দিকে আরও বেশি পানি ছিল। কেউ বের হতে পারেনি। এখন বিকালবেলা পানি একটু কমেছে, টান ধরেছে নদীর দিকে। সড়কে তবুও হাঁটুপানি। সেই পানি পার হয়ে বাড়ি থেকে বাজার-সদাই কিনতে সব বয়সী মানুষ হাটবারের হাটে যাচ্ছে। তিন দিনের বন্যায় তারা এখনও কোনও ত্রাণসহায়তা, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাননি।
হাসিনা বেগম, আজিজুল ইসলাম, আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘তিন দিন হলো পানি আসছে। ক্ষেতখামার সব তলিয়ে গেছে। কোনও সরকারি লোক আসে নাই। একফোঁটা ত্রাণ দেয় নাই। চেয়ারম্যান- মেম্বাররা আসে নাই।’
সরেজমিনে এমন চিত্রই ওঠে আসে প্রতিবেদকের ক্যামেরায়। এক এক করে তারা তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেন।
রবিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে সকাল ৬টায় ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। সকাল ৯টায় পানি কমে গিয়ে ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বিকাল ৩টায় ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
অপরদিকে, ভাটিতে থাকা তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে সকাল ৬টায় ২৯ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায় ৩১ সেন্টিমিটার এবং বিকাল ৩টায় ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী শুণিল কুমার এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের জলপাইগুঁড়ি ১৬৪, কালিম্পং ১৩০, দার্জেলিং ৭৭, কুচবিহার ৫৪ দশমিক শূন্য মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ভারত থেকে আসা ঢলের কারণে তিস্তা ব্যারাজের উজানে থাকা পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়নের লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ। রোপা আমনসহ শীতকালীন আগাম সবজি। ক্ষতি হয়েছে শীতকালীন বীজতলার।’
দহগ্রামের কৃষক একরামুল বলেন, ‘ভারতের উজানের পানি দ্রুত ঢুকে পড়ছে। কোনও সহযোগিতা নাই। রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তিস্তা ভাঙন ও পানি রোধে কেউ ব্যবস্থা নেয়নি।’
দহগ্রামের ইউপি সদস্য মো. রাব্বানি বলেন, ‘বেশ কিছু এলাকায় ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। ক্রমাগত আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে পানি। এ পর্যন্ত কোনও ত্রাণসহায়তা পাইনি। চেয়ারম্যান পরিষদে নাই। বিএনপির কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোকজন আমাদের ইউনিয়ন পরিষদে যেতে দিচ্ছে না।এ অবস্থায় আপদকালীন কিছু করার নাই।’
ভাটিতে থাকা কালিগঞ্জ, আদিতমারী, লালমনিরহাট সদর উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকার ফসলের মাঠ পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এতে ওই এলাকার আগাম জাতের ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
চর শৌলমারী ব্লকের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফরিদ বলেন, ‘চীনা বাদামের ক্ষতি হয়েছে। শীতকালীন সবজির ক্ষতি হয়েছে। ধানের কী রকম ক্ষতি হবে, তা বলা যাচ্ছে না। বৃষ্টির পরে কারেন্ট পোকা নামের একধরনের পোকার আক্রমণ হতে পারে। তবে পানি না কমলে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব বলা যাচ্ছে না।’
জেলা খামারবাড়ির উপপরিচালক ড. মো. সাইখুল আরেফিন বলেন, ‘বৃষ্টির পানি আমনের ক্ষেতে আমাদের জন্য রহমতের মতো। মাঠপর্যায়ে আগাম নির্দেশনা দেওয়া আছে। তারা খোঁজখবর রাখছেন। কিছু শীতকালীন সবজিক্ষেতে পানি আছে। এগুলো দুই-একদিনের মধ্যে পানি নেমে গেলে রিকভার হবে। উজানের পানি না আসলে ক্ষতির সম্ভবনা কম। দুই-চার দিন পরে ক্ষয়ক্ষতি বোঝা যাবে।’
রংপুর আবহাওয়া দফতরের প্রধান আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আগামী ২৪ ঘণ্টায় রংপুর অঞ্চলের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে। কিছু এলাকায় দমকা হাওয়াসহ মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে।’
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বন্যাকবলিত স্থান পরিদর্শন করেছি। লালমনিরহাটে এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিশুখাদ্যের জন্য ৫ লাখ টাকা, নগদ ১৩ লাখ টাকা, চাল ৯০ মেট্রিক টন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে সবকিছু তদারকি করা হচ্ছে।’