ঝুমন দাস আপনের কথা সবাই ভুলতে বসেছে। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে এই যুবক দুই মাস ধরে কারাগারে আটক। ফেসবুকে হেফাজত ইসলামের নেতা মামুনুল হককে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ঝুমন। সেই ‘অপরাধে’ ঝুমনকে আটক করে পুলিশ। এর পরদিন তার গ্রাম নোয়াগাঁওয়ে তাণ্ডব চালায় মামুনুলের অনুসারীরা। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় গ্রামের প্রায় ৯০টি হিন্দু বাড়ি।

যে হেফাজত নেতার সমালোচনা করে ফেসবুকে লিখেছিলেন ঝুমন, সেই মামুনুল এখন দেশজুড়ে সমালোচিত-বিতর্কিত। সহিংসতাসহ নানা অভিযোগে তিনি কারাগারে। আটকের পর প্রথমে ঝুমনকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হলেও পরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে পুলিশ। এই মামলায় হাকিম আদালত এবং জেলা জজ আদালতে আবেদন করেও জামিন মেলেনি। সর্বশেষ ১৬ মে সুনামগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ঝুমন দাসের জামিন আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আদালত কোনো আদেশ দেয়নি। এমনকি আদেশের তারিখও নির্ধারণ করেনি। জজ আদালত কোনো আদেশ না দেয়ায় উচ্চ আদালতেও যেতে পারছে না ঝুমনের পরিবার।

গত ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে শানে রিসালত সম্মেলন নামে একটি সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এতে হেফাজতের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বক্তব্য দেন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আগে থেকেই সমালোচনায় ছিলেন মামুনুল হক। দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। এ অবস্থায় দিরাইয়ের সমাবেশে এসে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেন মামুনুল হক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করতে গিয়ে সাম্প্রাদায়িক বিদ্বেষমূলক বক্তব্যও রাখেন।

এই সমাবেশের পরদিন ১৬ মার্চ মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন দিরাইয়ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের যুবক ঝুমন দাস আপন। স্ট্যাটাসে তিনি মামুনুলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ আনেন। ঝুমনের এমন স্ট্যাটাসে ক্ষেপে যান হেফাজত ইসলাম ও মামুনুলের স্থানীয়া অনুসারীরা। তারা মামুনুলের সমালোচনাকে ইসলামের সমালোচনা বলে এলাকায় প্রচারণা চালাতে থাকেন। এতে এলাকাজুড়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা ১৬ মার্চ রাতে ঝুমন দাসকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। এরপর রাতেই স্থানীয় বাজারে হেফাজতে ইসলামসহ স্থানীয় মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে প্রশাসন। এ সময় ঝুমন দাসকে আটকের খবর জানিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়। প্রশাসনের আহ্বানে তখন শান্ত থাকার আশ্বাস দেন উপস্থিত সবাই।

তবে পরদিন ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সকালে সারা দেশ যখন উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত, তখন কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে হামলা চালায় নোয়াগাঁও গ্রামে। তারা ভাঙচুর করে ঝুমন দাসের বাড়িসহ হাওরপাড়ের হিন্দু গ্রামটির প্রায় ৯০টি বাড়ি, মন্দির। লুটপাট করা হয় মূল্যবান সম্পদ। ১৬ মার্চ ঝুমন দাসকে আটকের পর ১৭ মার্চ ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঝুমনকে আদালতে পাঠায় শাল্লা থানা পুলিশ। এরপর ঝুমনের গ্রামে তাণ্ডব নিয়ে যখন দেশজুড়ে সমালোচনা চলছে, ওই গ্রামে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তখন আচমকা ২২ মার্চ ঝুমনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে শাল্লা থানা পুলিশ। শাল্লা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল করিম এই মামলা করেন।

কেবল ঝুমন দাসই নয়, মামুনুল হকের সমালোচনা করে সুনামগঞ্জে আরও একাধিক ব্যক্তিকে পুলিশি হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। মামুনুলের রিসোর্ট-কাণ্ডের পর ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রলীগ নেতা আফজাল খান (২৪)। এরপর সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার মহেশপুর গ্রামের বাসিন্দা আফজালকে হেনস্তা করে স্থানীয় কয়েকজন। পরে তাকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।

কেবল ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে মামলা নয়, শাল্লায় হিন্দু বাড়িঘরে হামলা ঠেকাতেও পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আগে থেকে আভাস পেয়েও প্রশাসন এই তাণ্ডব ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় লোকজন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদন্তেও এমন অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। শাল্লার তাণ্ডবে পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ ওঠায় এ ঘটনা তদন্তে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিনকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর। ২৬ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেয় এই কমিটি।

প্রতিবেদনে হামলার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ সুপারসহ (এসপি) ১১ জনকে বদলি এবং ৬ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, সুনামগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদীন, দিরাই সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সুফিয়ান, সুনামগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আলী পাঠান, শাল্লা থানার তৎকালীন ওসি নাজমুল হক ও দিরাই থানার তৎকালীন ওসি আশরাফুল ইসলামসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়।

এই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে শাল্লা থানার ওসি নাজমুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং দিরাই থানার ওসি আশরাফুল ইসলামকে মৌলভীবাজার জেলায় বদলি করা হয়। নোয়াগাঁও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাস বলেন, ‘ঝুমন কোনো ধর্ম, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বক্তব্য দেয়নি। সে একজন ব্যক্তির সমালোচনা করেছে। এ কারণে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে জেলা রাখা অযৌক্তিক। আমরা তার মুক্তি চাই এবং যারা আমাদের গ্রামে হামলা ও লুটপাট করেছিল সবার গ্রেপ্তার চাই।’

ঝুমন দাসের আইনজীবী দেবাংশু শেখর দাস বলেন, ‘আমরা প্রথমে নিম্ন আদালতে ঝুমন দাসের জামিন আবেদন করেছিলাম। আদালত জামিন নাকচ করেছেন। এরপর গত ১৬ মে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদনের শুনানি হয়। কিন্তু আদালত কোনো আদেশ দেননি। আদেশের তারিখও নির্ধারণ হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আদালত যদি জামিন নাকচ করতেন তাহলে আমরা উচ্চ আদালতে যেতে পারতাম। কিন্তু কোনো আদেশ না দেওয়ায় উচ্চ আদালতেও যেতে পারছি না।’

দেবাংশু দাস বলেন, ‘আগামী রোববার আমি আবার বিষয়টি আদালতের কাছে উত্থাপন করে একটি আদেশ প্রার্থনা করব। এ প্রসঙ্গে ঝুমন দাসের মা নিভা রানী দাস বলেন, ‘আদালতে একাধিকবার আবেদন করেও আমার ছেলের জামিন হচ্ছে না। বড় বড় আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়। অথচ ফেসবুকে লেখার কারণে সে দুই মাস ধরে কারগারে আছে। ঝুমনের মা বলেন, ‘ছেলেকে গ্রেপ্তারের পর আমাদের ঘরসহ গ্রামের সকল বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা হলো। আমার পুত্রবধূকে হেনস্তা করা হয়েছে। আর কী শাস্তি পাওয়ার বাকি আছে আমাদের?’

এই মামলায় ঝুমনের জামিন পাওয়া উচিত বলে মনে করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ সুনামগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। তিনি ঝুমনের মুক্তি দাবি করে বলেন, জামিনের পর তার নিরপত্তার বিষয়টিও প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।

Related posts

পরীক্ষামূলক বাতি জ্বললো পদ্মা সেতুতে

News Desk

ভাইস চেয়ারম্যানের ছেলের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানকে চড়-থাপ্পড়ের অভিযোগ

News Desk

দেশজুড়ে ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত ১১ হাজার

News Desk

Leave a Comment