মিয়ানমারের রাখাইনে এখনও নিপীড়ন আর হত্যাযজ্ঞ চলছে। নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার সাত বছর আজ। দিনটিকে কালোদিন ঘোষণা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন রোহিঙ্গারা। এ উপলক্ষে রবিবার সকাল ৯টা থেকে উখিয়ার কুতুপালংয়ের ফোর এক্সটেনশন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের খেলা মাঠে সাত বছর পূর্তির ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের জন্য রোহিঙ্গারা জড়ো হন। বেলা ১১টার দিকে মাঠটি ভরে যায়।
সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ প্রায় অর্ধলাখ রোহিঙ্গা অংশ নেন। সমাবেশ থেকে জানানো হয়, রাখাইনে ‘সেফজোনে’ ফিরতে চান রোহিঙ্গারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে আশপাশের ক্যাম্প থেকে খেলার মাঠে জড়ো হয়েছেন রোহিঙ্গারা। এবার আরাকান আর্মিসহ জান্তা সরকারের বিচার চেয়ে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবি তোলেন তারা। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার আব্দুর রশিদ, ছৈয়দ উল্লাহ, মোহাম্মদ মুসা ও মাস্টার কামাল প্রমুখ।
সমাবেশের শুরুতে মিয়ানমার জেনোসাইডে নিহত সবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। বেলা সোয়া ১১টায় শুরু হয় সমাবেশ। সেখানে কয়েকজন বক্তার মুখে উঠে আসে, রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির কথা। জান্তা সরকারের দমন-নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গারা এখন সে দেশের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির হাতে নির্যাতিত হচ্ছেন বলে বক্তারা অভিযোগ করেন। বিদ্রোহীরা রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি হত্যাও করছে বলেও জানান। এ অবস্থায় বাংলাদেশের নতুন সরকারের সহযোগিতা চান তারা।
সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ছাত্র-জনতার এই বিজয় রোহিঙ্গাদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছেন ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ হলে দুনিয়ার কোনও শক্তি টিকে থাকতে পারে না। তেমনিভাবে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামলে তাদের নিপীড়ন ও অত্যাচারের দিন শেষ হবে বলে মনে করেন তারা।
রোহিঙ্গা নেতা ছৈয়দ উল্লাহ সমাবেশে বলেন, ‘এ দেশে কোন সরকার এলো বা কোন সরকার গেলো, তা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাথাব্যথা নেই। তবে রোহিঙ্গারা চান দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকুক। কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বেগ পেতে হবে।’
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পর এবার রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে আরাকান আর্মি উল্লেখ করে ছৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘আরাকানের জমিতে আরাকান আর্মি গত মে মাসে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা হত্যা করেছে। আগস্ট মাসে বোমা হামলায় বহু মানুষকে হত্যা করেছে তারা। ফলে এখনও টেকনাফের নাফ নদে রোহিঙ্গাদের লাশ ভাসছে। বর্তমানে ছাত্র-জনতার হাত ধরে দেশ বদলে যাচ্ছে। আরাকানমুক্ত করতে হলে আমাদের ছাত্রদের প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের ছাত্রদের মতো তাদেরও লড়তে হবে। বাংলাদেশের মাটিতে আসার আমাদের সাত বছর পার হয়ে গেছে। সমস্যার সমাধান হয়নি। আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলছি, আমরা রাখাইনে সেফজোন পেলে ফিরে যাবো।’
আজকের সমাবেশে সশস্ত্র গোষ্ঠীর গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর গড়ে তোলা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা পিস ফর হিউম্যান রাইটসের কোনও নেতাকে দেখা যায়নি। এমনকি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করা মুহিবুল্লাহর কথা সমাবেশে স্মরণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা।
আরাকান রোহিঙ্গা পিস ফর হিউম্যান রাইটসের সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘ক্যাম্পে সাত বছর উপলক্ষে আজকে গণহত্যা দিবসে পালন করা হয়েছে। কিন্তু এই দিনটি পালন করতে যার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে, সেই নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহর নাম পর্যন্ত সমাবেশে নেওয়া হয় না। এটি খুবই দুঃখজনক।’
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তার কারণে সমাবেশে যাওয়া হয়নি জানিয়ে এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে গণহত্যার কারণে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়েছেন। তখন সেখানে আরও সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা ছিল। কিন্তু এখন আরাকান আর্মি যুদ্ধের নামে সেই রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করছে। এর প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। ড্রোন থেকে বোমা ফেলে রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে তারা। সেখানে এখনও হত্যাযজ্ঞ চলছে। তবু আমরা আর বাংলাদেশের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। নিরাপত্তা পেলে আমরা এখনই মিয়ানমারে ফিরে যাবো। এত বছর আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।’
ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ ইকবাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গাদের কর্মসূচি শেষ হয়েছে। যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন।’
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামসুদ্দৌজা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন হয়েছে। সেখানে তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন।’