ঘুষ না দিলে মেলে না ভূমিসেবা
বাংলাদেশ

ঘুষ না দিলে মেলে না ভূমিসেবা

ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের রেকর্ডরুমে ঘুষ ও দালাল ছাড়া মিলছে না জমির খতিয়ানের নকল (পরচা)। ভূমি মালিকদের অভিযোগ, অনলাইনে আবেদন করেও রেকর্ডরুমের কর্মচারীদের ঘুষ না দিলে কিংবা দালাল না ধরলে মিলছে না ভূমিসেবা। মাসের পর মাস পরচার জন্য ঘুরতে হচ্ছে তাদের। ভোগান্তি থেকে বাদ যাচ্ছেন না আইনজীবী কিংবা মুক্তিযোদ্ধারাও। ভূমিসংক্রান্ত যেকোনো সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, জমির খতিয়ানের নকল (পরচা) সংগ্রহ করতে হলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আগে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হতো। আবেদনের ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রেকর্ডরুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনারের দফতর থেকে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী পরচা সরবরাহ করা হতো। মানুষ যাতে সহজে ও দ্রুত সময়ে পরচা পেতে পারেন, তার জন্য ২০২১ সাল থেকে দেশে অনলাইনে ভূমিসেবা কার্যক্রম চালু করে সরকার। এর মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করে ডাকযোগে পরচা পাওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়। পরের বছর এই সেবা চালু করা হয়। একজন গ্রাহক পরচা পেতে অনলাইনে আবেদন ফরম পূরণ করলে দুটি অপশন আসে। একটি ডাকযোগে, আরেকটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সশরীর সংগ্রহ করা। ডাকযোগে পেতে গ্রাহককে ১৪০ টাকা ফি দিতে হয়। আর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে নিতে হলে গ্রাহককে ১০০ টাকা ফি দিতে হয়। তবে প্রতিশ্রুত ফি দিয়ে পরচা পাননি গ্রাহকরা।

জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাটের কৃষ্টনগরের কৃষক রবি মিয়ার (৫০) পারিবারিক ৮০ শতক বাড়ির জমির জাল দলিল করে চাচাতো ভাই সাবজুল গংরা দখলে নিয়েছেন। পৈতৃক সম্পত্তি ফিরে পেতে আদালতে আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলে ওই জমির সিএস ও আরওআরের খতিয়ানের নকল দরকার হয়। সেগুলো তোলার জন্য গত তিন মাস আগে জেলা প্রশাসকের দফতরেরর রেকর্ডরুমে অনলাইনে আবেদন করেন। আবেদনের পর থেকে ওই জমির খতিয়ানের নকলের জন্য জেলা প্রশাসনের রেকর্ডরুমের রেকর্ড কিপার মোখলেছুর রহমানসহ অন্য কর্মচারীদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। কিন্তু তিন মাস পেরিয়ে গেলেও পাননি।

রবি মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিএস ও আরওআর-এর খতিয়ানের নকলের জন্য তিন মাস আগে আবেদন করেছিলাম। এরপর অন্তত আট বার হালুয়াঘাটের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে টাকা খরচ করে জেলা প্রশাসনের রেকর্ডরুমে আসা-যাওয়া করছি। এ পর্যন্ত আসা-যাওয়াসহ অন্যান্য খরচ বাবদ পাঁচ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। রেকর্ড কিপার মোখলেছুর রহমান অন্য কর্মচারীর মাধ্যমে আড়াই হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছেন। কিন্তু আমার কাছে তাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা না থাকায় দিতে পারিনি। এ কারণে এখনও জমির খতিয়ানের নকল দেয়নি। শুধু ঘুরতেছি। নকল না পাওয়ায় আদালতে মামলা করতে পারছি না আমি।’    

শুধু রবি মিয়া নন, অনলাইনে আবেদন করে সিএস, এসএ, আরওআর এবং বিআরএসের খতিয়ানের নকলের জন্য মাসের পর মাস রেকর্ডরুমে ঘুরে ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেকে। তাদের অভিযোগ, রেকর্ড কিপার মোখলেছুর রহমান ও অন্য কর্মচারীদের ঘুষ না দিলে অথবা দালাল না ধরলে মিলছে না খতিয়ানের নকল।

ভোগান্তির কথা জানিয়ে ফুলবাড়ীয়া উপজেলার কৃষক রঞ্জু মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে, ‘পারিবারিক জমি বিক্রির জন্য বিআরএসের খতিয়ানের নকল উঠাতে অনলাইনে গত ২৬ জানুয়ারি আবেদন করেছি। আবেদনের পর থেকে নকলের জন্য জেলা প্রশাসনের রেকর্ডরুমে খোঁজ নিচ্ছি। কিন্তু দিচ্ছে না। রেকর্ড কিপার মোখলেছুর রহমান আজ কিংবা কাল বলে ঘোরাচ্ছেন। মোখলেছুর রহমান ঘুষ চেয়েছেন। অথবা দালাল ধরতে বলেছেন। কিন্তু দালাল তিন হাজার টাকা চাচ্ছেন। এ অবস্থায় টাকা ছাড়া খতিয়ানের নকল তুলতে পারছি না।’

একই ভোগান্তির কথা জানালেন জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী আব্দুল কাদের। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘রেকর্ডরুম থেকে ঘুষ ছাড়া কোনও সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। আমরাও সহজে কোনও সেবা পাই না। আর গ্রামের সাধারণ মানুষের অবস্থা তো আরও খারাপ। আদালতে মামলার কাজে জমির খতিয়ানের নকল প্রতিনিয়ত উঠাতে হয়। কিন্তু সহজে পাওয়া যায় না। দালাল ধরলে কিংবা অফিসের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা দিলে সহজেই নকল পাওয়া যায়।’

রেকর্ডরুম থেকে সেবা পেতে গ্রামের মানুষকে মাসের পর মাস ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা রজব আলী শেখ। তিনি বলেন, ‘আমার মুক্তিযোদ্ধারাও সময়মতো সেবা পাচ্ছি না। বিষয়টি নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার।’

তবে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রেকর্ড কিপার মোখলেছুর রহমান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘সার্ভার জটিলতার কারণে সময়মতো ভূমিসেবা দেওয়া যাচ্ছে না গ্রাহকদের।’ কতদিন ধরে সার্ভার জটিলতা দেখা যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে সমস্যা দেখা দেয়।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভূমিসেবা দেওয়ার কার্যক্রমে কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ নিলে কিংবা অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তবে জেলা প্রশাসকের এমন আশ্বাসে সন্তুষ্ট নন ভুক্তভোগীরা। জেলা শহরের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ভূমি মালিকদের এই দুর্ভোগ নিরসনে জেলা প্রশাসককে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।’

Source link

Related posts

সাদ-জুবায়েরপন্থিদের বিরোধ, এক মসজিদ ঘিরে দিনভর কড়া নিরাপত্তা

News Desk

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে নানা আয়োজন

News Desk

শাবিপ্রবির পিসিআর ল্যাবে ৬৬ জন করোনা রোগী শনাক্ত

News Desk

Leave a Comment