চট্টগ্রামে অস্থির পেঁয়াজের বাজার। ভারত পেঁয়াজ রফতানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর থেকে চট্টগ্রামে পেঁয়াজের বাজারে এ অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। রাতারাতি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি বেড়েছে ৭০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত। হঠাৎ অস্বাভাবিক দামে পেঁয়াজ বিক্রি হওয়ায় অভিযানে নামে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং ভোক্তা অধিকার। অভিযানের কারণে রবিবার (১০ ডিসেম্বর) থেকে পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের বাজার চাকতাই-খাতুনগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী।
এদিন চাকতাই-খাতুনগঞ্জের অধিকাংশ আড়তই ছিল পেঁয়াজশূন্য। এ দুই পাইকারি বাজারে প্রতিদিন যেখানে ২০ থেকে ২৫ ট্রাক (প্রতি ট্রাকে ১৫ টন) পেঁয়াজ ঢুকে সেখানে আজ (রবিবার) ঢুকেছে মাত্র এক ট্রাক। অভিযানের কারণে খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমলেও এর প্রভাব পড়েনি খুচরা বাজারে। খুচরা বাজারে এখনও ২২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে, পেঁয়াজের এমন অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি মানতে নাকাল সাধারণ ক্রেতারা। ক্যাব নেতারাও বলছেন, ‘যে পণ্য এখন বাজারে আছে সেগুলো অনেক আগের কেনা। এগুলোতে দাম বাড়ানোর কোনও যুক্তিকতা নেই। দেশের ব্যবসা ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা এ সুযোগ নিচ্ছে।’
এদিকে, আজ রবিবার ও গতকাল শনিবার সকাল থেকে নগরীর প্রধান ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি বাজারে অভিযান চালিয়েছে প্রশাসনের পৃথক টিম। অভিযানে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করায় বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। তবে অনেকটাই পেঁয়াজশূন্য চাকতাই ও খাতুনগঞ্জ।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. উমর ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রবিবার খাতুনগঞ্জে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করায় দুটি প্রতিষ্ঠানকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তবে খাতুনগঞ্জে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ নেই। যে পরিমাণ পেঁয়াজের ট্রাক স্বাভাবিক সময়ে ঢুকে সেভাবে আজ আসেনি। বিষয়টি আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি।
বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করায় আজ দুপুরে নগরীর পাহাড়তলী বাজার এবং বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় অভিযান চালিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। অভিযানে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে শনিবার দুপুরে নগরীর চৌমুহনী কর্ণফুলী মার্কেট এবং খাতুনগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। অভিযানে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করে সংস্থাটি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর চট্টগ্রাম সহকারী পরিচালক রানা দেবনাথ বলেন, ‘বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রির অভিযোগে এসব প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
অপরদিকে, জেলা প্রশাসনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট রাকিবুল ইসলাম নগরীর পাহাড়তলী বাজারে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট রাকিবুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূল্য তালিকা না থাকা এবং বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রির অভিযোগে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানে পেঁয়াজ কেনার কোনও ক্রয় রসিদ দোকানিরা দেখাতে পারেননি। তবে কয়েকজন দোকানি একটি হাতে লেখা ক্রয় রসিদ দেখিয়েছেন। যেখানে তারা খাতুনগঞ্জ থেকে কেজি ১৯৭ টাকা করে কিনেছেন বলে উল্লেখ আছে। তবে এই ক্রয় রসিদটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রবিবার চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার চাকতাই-খাতুনগঞ্জে কেজিপ্রতি ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি করা হয় ১৯০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। চীন থেকে আমদানি করা বড় সাইজের পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। খুচরায় প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে ২২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকায়। চীনা পেঁয়াজ খুচরায় বিক্রি করা হচ্ছে ১৬০ টাকা করে। অথচ, আগের দিন শনিবার (৯ ডিসেম্বর) চাকতাই খাতুনগঞ্জে ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। চীন থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। যদিও গত বৃহস্পতিবার খাতুনগঞ্জে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি করা হয় ১০০ টাকা এবং চীনা পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়।
শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে ভারত। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশটি আর পেঁয়াজ রফতানি করবে না। এমন খবরে দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম।
খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশাসনের অভিযানের কারণে রবিবার কেজিপ্রতি ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি করা হয় ১৮০ টাকা থেকে ১৯০ টাকা। চীন থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি করা হয় ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। তবে চাকতাই-খাতুনগঞ্জে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ নেই। আগে যেখানে দিনে ২০ থেকে ২৫ ট্রাক পেঁয়াজ আনা হতো, সেখানে আজ পেঁয়াজ আনা হয় মাত্র এক ট্রাক (১৫ টন)।’
তিনি বলেন, এখানে অভিযান চালিয়ে লাভ নেই। অভিযান চালাতে হবে আমদানিকারকদের মাঝে। স্থলবন্দরের সোনা মসজিদ, হিলি, ভোমরা এলাকায় গুদামে অভিযান চালালে কাঙ্ক্ষিত সুফল আসবে। আমরা কমিশনের ওপর ভিত্তি করে পেঁয়াজ বিক্রি করে থাকি। আমদানিকারকরা আমাদের দাম নির্ধারণ করে দেন। আমাদের সেই দামে বিক্রি করতে হয়।’
রবিবার দুপুরে নগরীর আতুরারডিপো বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখানে খুচরায় প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকায়। চীনের বড় সাইজের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। পাইকারিতে কমলেও খুচরায় এর প্রভাব পড়েনি।
একদিনের ব্যবধানে ১০০ টাকার পেঁয়াজ ২৪০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় সাধারণ ক্রেতাদের মাঝে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মো. রফিক নামে এক ক্রেতা জানান, ‘একদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ২৪০ টাকা হওয়ার কোনও কারণ নেই। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে পেঁয়াজের এত দাম বেড়েছে। অথচ আগের দামে কেনা পেঁয়াজ হঠাৎ এত টাকা হওয়ার কোনও কারণ নেই। দাম বাড়ানোর পেছনে দায়ী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর অভিযান চালানো প্রয়োজন।’
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে চীন ও পাকিস্তান থেকে ৮৩০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়েছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুক্রবার ভারত মার্চ মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে, এমন অজুহাতে দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। ১০০ টাকার পেঁয়াজ হয়েছে ১৫০ টাকা। একদিন পর শনিবার এই পেঁয়াজ হয়েছে ২২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা। এটাকে সুযোগ মনে করে কাজে লাগাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে। যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে তা দিয়ে অন্তত আরও এক মাস দেশের চাহিদা মেটানোর কথা। তার ওপর দেশে নতুন পেঁয়াজ কৃষকরা বাজারে আনার সময় হয়েছে। অথচ দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি সংস্থাগুলো জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। সে সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের নীতিনৈতিকতাও যেন হারিয়ে গেছে।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘কোনও আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য অবৈধভাবে মজুত কিংবা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ালে জেলা প্রশাসন মজুত করা পণ্য জব্দ করতে পারে। এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে আড়ত এবং বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে জেল-জরিমানা, পণ্য জব্দ, আড়ত-দোকান সিলগালাসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে পেঁয়াজের ক্রমবর্ধমান মূল্য নিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সঙ্গে বসে তাদের মতামত, পরামর্শ ও যুক্তি শুনবো।’