কবে চালু হবে চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে?
বাংলাদেশ

কবে চালু হবে চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে?

উদ্বোধনের প্রায় ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি চট্টগ্রাম নগরের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত এই এক্সপ্রেসওয়ে গাড়ি চলাচলে দুই মাস লাগার কথা জানিয়েছিলেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ আগস্ট মাসে গাড়ি চলাচল শুরুর কথা বলেছিল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। কিন্তু সরকার পতনের পর কাজ থেমে গেছে। এখন কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছুই জানাতে পারছেন না সিডিএর কর্মকর্তারা।

সিডিএ জানায়, মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হলেও নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে। সংস্থাটির পরিকল্পনা ঘাটতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ১৪ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশে ১৫৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি চট্টগ্রাম নগরের ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে’-এর উদ্বোধন করেছিলেন।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মনগড়া সমীক্ষা করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প নির্মাণে হাত দেওয়া হয়েছে। যে কারণে বারবার নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সময় ও প্রকল্প ব্যয়। প্রকল্পটিতে কী পরিমাণ অর্থের লুটপাট হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

সিডিএ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরমুখী এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার হওয়ার কথা ছিল। বর্তমানে তা ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার। প্রাথমিক সমীক্ষায় ২০টি র‌্যাম্প (যানবাহন ওঠানামার পথ) নির্মাণ করার কথা থাকলেও করা হয়েছে ১৪টি। এর থেকে আরও চার-পাঁচটি অপ্রয়োজনীয় র‌্যাম্প কমানোর চিন্তা করছে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। র‌্যাম্পের মোট দৈর্ঘ্য ১২ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে আছে মাত্র অর্ধেক। চালুর আগে এত পরিবর্তনের কারণে বেড়ে গেছে ব্যয়ও। সিডিএর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান র‍্যাঙ্কিন।

বেড়েছে সময় ও প্রকল্প ব্যয়

এক্সপ্রেসওয়ে চালুর কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। পরে তা পরিবর্তন করে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে আরও এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই গত বছরের ১৪ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এত বছরেও নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় এর সুফল পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালে একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন হওয়ার সময় তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণকাজের উদ্বোধন হলেও ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২২ সালে নকশা সংশোধন করে আরও এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপরও কাজ শেষ না হওয়ায় সর্বশেষ প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ পুরো শেষ করা যাবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

যেসব কারণে কাজ শেষ হতে দেরি

লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ নামে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর চট্টগ্রাম বন্দরের আপত্তি, জমি অধিগ্রহণের জন্য অপেক্ষা, ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি না পাওয়া, লালখান বাজার অংশের নকশা নিয়ে আপত্তি, কোভিডের সময় কাজে ধীরগতি, বিকল্প সড়ক চালু করতে দেরি এবং বন্দর সংশ্লিষ্ট এলাকায় নকশা পরিবর্তনসহ নানা কারণে প্রকল্পের কাজে দেরি হয়।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক্সপ্রেসওয়ের মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে গত এপ্রিলে। তখন থেকে যান চলাচলের উপযোগী হয়ে যায়। কিন্তু সড়কবাতি, ক্লোজড সার্কিট টিভি (সিসিটিভি) ক্যামেরা স্থাপনের কাজ বাকি রয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ের মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদনের সময় টোল আদায়ের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। কিন্তু মূল অবকাঠামো নির্মাণের জন্য দরপত্র দিলেও সেখানে টোল প্লাজার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। ছিল না সড়কবাতি ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের কাজও। নির্মাণকাজের শেষ পর্যায়ে এসে গত বছরের এপ্রিলে এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প নির্মাণ এবং টোল প্লাজা স্থাপনের জন্য দরপত্র দিয়েছিল। কিন্তু টোল প্লাজা স্থাপনের দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। টোল প্লাজার জন্য আবার নতুন করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দরপত্র আহ্বান করেছিল সিডিএ। 

প্রকল্প সূত্র জানায়, ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েতে প্রায় ১ হাজার ৩০০টি সড়কবাতি লাগানো হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশে এসেছে ৬০০টি। বাকি ৭০০ বাতি চলতি মাসে দেশে আসার কথা রয়েছে। আর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন অংশে ২০০টি শক্তিশালী সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। তাইওয়ান থেকে এসব ক্যামেরা আসার কথা। 

র‌্যাম্প নির্মাণকাজ এখনও শেষ হয়নি

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প নির্মাণকাজ এখনও শেষ হয়নি। তবে লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে প্রস্তুত। গত কিছু দিন ধরে পরীক্ষামূলকভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য এটি খুলে দেওয়া হয়েছে। এটিতে গাড়ি চলাচল করতে হলে টোল দিতে হবে। টোল আদায়ের অনুমতির জন্য ফাইল মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, আগামী সপ্তাহে অনুমোদন পাওয়া যাবে। এরপর টোল আদায়ের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে।

বারবার সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার আপত্তির কারণে নকশায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ কারণে সময় ও ব্যয় বেড়েছে। শুরুতেই ১৪টি র‌্যাম্প থাকার কথা ছিল। এর মধ্যে টাইগারপাস মোড় এলাকায় উঠতি র‌্যাম্প নির্মাণে বাঁধা দেন পরিবেশবিদরা। এ ছাড়া কম দূরত্বে থাকা আরও চার-পাঁচটি র‌্যাম্প বাদ দেওয়া হবে। এতে প্রকল্পে অন্তত ৪০০ কোটির বেশি টাকা সাশ্রয় হবে।

র‌্যাম্প নির্মাণে বাধা

এদিকে, যানজট ও দুর্ভোগ সৃষ্টি হওয়ায় নগরের ওয়াসাস্থ বাউয়া স্কুলের সামনে র‌্যাম্প নির্মাণে বাধা দিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, র‌্যাম্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যানজটসহ যে দুর্ভোগ হচ্ছে তা সাময়িক। আমরা শিক্ষার্থীদের বলেছি দিনের বেলায় নয়, প্রয়োজনে রাতে র‌্যাম্প নির্মাণের কাজ করা হবে। এরপরও যদি বাধা আসে তাহলে কাজ বন্ধ করা ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকবে না।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বোর্ড সদস্য জাহিদুল করিম কচি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে ঘিরে বিগত সরকারের সময়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। সিডিএতে নতুন প্রশাসকসহ আমরা নতুন সাত বোর্ড সদস্য দায়িত্ব নিয়েছি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। এখানে অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় র‌্যাম্প রাখা হয়েছে। সেগুলো আপাতত বাতিল করে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে র‌্যাম্পগুলো যাতে ভবিষ্যতে করা যায়, সে ব্যবস্থা রাখা হবে।

চলছে পরীক্ষামূলক যানবাহন

ইতিমধ্যে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল করছে পরীক্ষামূলক যানবাহন। টোল ছাড়াই গত ১৫ দিন ধরে এসব গাড়ি টাইগারপাস থেকে পতেঙ্গায় আসা যাওয়া করছে। তবে র‌্যাম্পগুলোর নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় এর সুফল মিলছে না। শুধুমাত্র যারা লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা যাবে কিংবা পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজার আসবে তারাই এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারছেন। এতে কমছে না নগরের যানজট।

চলতি বছর পুরো কাজ শেষ করার আশা

কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে জানতে চাইলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই প্রকল্পে লালখান বাজার এবং টাইগারপাস এলাকায় দুটি র‌্যাম্পের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আগ্রাবাদ, বাউয়া স্কুলের সামনেসহ অন্তত পাঁচটি র‌্যাম্পের নির্মাণকাজ চলমান। আশা করছি, চলতি বছরের বাকি সময়ের মধ্যে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ করা যাবে।

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, বিগত সরকারের মেগা প্রকল্প মানেই ছিল মেগা দুর্নীতি। দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মেগা প্রকল্প ছিল বিগত সরকারের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের যন্ত্র। এই প্রকল্পে কী রকম অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, তা তদন্ত করে খুঁজে বের করা দরকার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটিতে টাইগারপাস থেকে পতেঙ্গা প্রান্তে মাত্র ১৫ মিনিটে পার হওয়া যাচ্ছে। পুরো চালু হলে লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ২০ মিনিট। সাধারণত টাইগারপাস থেকে পতেঙ্গা প্রান্তে যেতে অন্তত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লেগে যেতো। সেখানে ১৫ মিনিটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে এই পথ পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে। এতে সাশ্রয় হচ্ছে সময়। তবে র‌্যাম্প চালু না হলে এর সুফল মিলবে না বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

Source link

Related posts

পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ

News Desk

হাসপাতালে এক যুগ পর অস্ত্রোপচার, খরচ হয়নি রোগীর

News Desk

প্রতিমন্ত্রী মুরাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করা হবে: কাদের

News Desk

Leave a Comment