ব্যাংকগুলোর মধ্যরাতে সভা করে ঋণখেলাপিদের দায়মুক্তি দিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়া নৈতিকতাবিরোধী। যে পরিমাণ ঋণ আদায় করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি অবলোপন করা হচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টরে ১০ শতাংশ ঋণখেলাপির যে তথ্য দেওয়া হয়, সেটিও সঠিক নয়।
আজ শনিবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (এফডিসি) ‘আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের সদিচ্ছা’ শীর্ষক ছায়া সংসদের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সে সময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি সংগঠন এই ছায়া সংসদের আয়োজন করে। এ ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকেরা। এতে সমান নম্বর পেয়ে দুই দলই বিজয়ী হয়।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী, ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজরা যেন আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন, সে বিষয়ে নতুন নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) দৃঢ় অবস্থান দেখাতে হবে। কোনো ঋণখেলাপি যাতে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের সদস্য হতে না পারেন, সে বিষয়ে ব্যাংক মালিকদের সতর্ক থাকার আহ্বানও জানান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। একই সঙ্গে ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সদিচ্ছা ও যোগ্যতার অভাব রয়েছে। তাই ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা এড়িয়ে চলেন।
আর্থিক খাতে যোগ্যতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গণতন্ত্র ও সুশাসনের পাশাপাশি আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন টেকসই হবে না। অনেক দৃশ্যমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাবে শ্রীলঙ্কার মতো দেশকে বাংলাদেশ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।
ছায়া সংসদের সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা দিনদিন ক্যানসারের রূপ ধারণ করছে উল্লেখ করে কিরণ বলেন, দেশে আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় ক্ষত ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচার। অর্থ পাচারে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সম্পৃক্ত। করোনা মহামারির দেড় বছরে দুবাইয়ে আবাসন খাতে চীনকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশিরা। জানা গেছে, একশ্রেণির বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলারা শুধু বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের জন্য গত দেড় বছরে বিনিয়োগ করেছেন ২৮৮ কোটি টাকা।
এ ছাড়া দুবাইয়ের বিভিন্ন ব্যাংকে কী পরিমাণে টাকা বাংলাদেশ থেকে পাচার করে জমা এবং দুর্নীতির অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। বাংলাদেশ থেকে গত এক দশকে ৩২ জন ২০ লাখ পাউন্ড বাংলাদেশি টাকায় ২৪ কোটি টাকা করে বিনিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে গোল্ডেন ভিসা সংগ্রহ করেছেন বলেও উল্লেখ করেন আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি ১০ দফা সুপারিশ দিয়েছে। সেগুলো হচ্ছে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন; দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সব দুর্নীতিবাজদের তালিকা জাতীয় সংসদসহ গণমাধ্যমে প্রকাশ; ব্যাংকিং খাতের আত্মসাৎ করা অর্থ আদায়ে ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করা; ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচার রোধে সর্বদলীয় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা; বড় বড় ঋণখেলাপির কেউ যাতে বিদেশে যেতে না পারেন, তার জন্য নৌবন্দর, স্থলবন্দর ও বিমানবন্দরগুলোতে ঋণখেলাপিদের তালিকা পাঠানো; রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ না দিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন, এমন দক্ষ পেশাদার ব্যক্তিকে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া; ব্যাংকিং খাতে অভিজ্ঞ নয়, এমন ব্যক্তিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ না দেওয়া; নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা যাচাই করা; চরম লোকসানে নিপতিত ব্যাংকগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা এবং সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ও পাচারকারীদের নাম সংগ্রহের জন্য সমঝোতা চুক্তি করা।