উজাড় হচ্ছে ঝাউবাগান, হুমকিতে টেকনাফ উপকূল
বাংলাদেশ

উজাড় হচ্ছে ঝাউবাগান, হুমকিতে টেকনাফ উপকূল

কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলের রক্ষক হিসেবে পরিচিত ঝাউবন কেটে উজাড় করা হচ্ছে। বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জোগসাজশে কাঠ ব্যবসায়ীরা ঝাউগাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। গত এক সপ্তাহে এখান থেকে অন্তত এক হাজার গাছ কাটা হয়েছে। এতে বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে উপকূল ও পরিবেশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রায় এক হাজার ১০০ একরে গড়ে তুলেছে সাবরাং পর্যটন পার্ক। এই পার্কের ভেতর সমুদ্রসৈকত ধরে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত রয়েছে সাড়ে চার কিলোমিটার ইটের সড়ক। এখানে দৃষ্টিনন্দন ঝাউবনের পাঁচ থেকে ছয়টি স্থান থেকে অবাধে গাছ কাটা হচ্ছে। বন উজাড় হওয়ায় সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে দ্রুত ভাঙছে সড়ক। ঝুঁকিতে আছে বেজার হাজার একর জমি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সৈকতের অনেক জায়গা থেকে ঝাউগাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। এই সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। সাবরাং পার্কের অসাধু কর্মকর্তা ও বন বিভাগের সহায়তায় স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী চক্র এসব গাছ কাটছে। দিনের পর দিন প্রকাশ্যে গাছ কাটলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

সরেজমিনে টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়কে দেখা যায়, জিরো পয়েন্ট, কাটা বনিয়া, কচুবনিয়াসহ চার-পাঁচটি স্থানে হাজারের বেশি গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সারিবদ্ধ গাছের মাঝে মাঝে ফাঁকা। পড়ে রয়েছে কাটা গাছের অসংখ্য গোড়া। কিছু কিছু গোড়া বালু দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। অনেক গাছে রয়েছে করাত ও দা দিয়ে কাটার চিহ্ন। সাবরাংয়ের আছরবনিয়ায় মেসার্স মোস্তাক সমিল অ্যান্ড স্টিল-১, সাবরাং বাজারের পশ্চিম পাশের মামুন সমিল, সাবরাং রাস্তার মাথার মেসার্স এসএন টিম্বার অ্যান্ড সমিলসহ একাধিক কাঠ কাটার মিলে ঝাউগাছের স্তূপ দেখা গেছে। অনেকের বাড়িতেও কাটা গাছ দেখতে পাওয়া যায়। 

এর মধ্যে মামুন সমিলে রাখা ঝাউগাছ নিয়ে সাব সৈকতের পাশ থেকে কাটা হয়েছে ঝাউগাছ রাংয়ের কাঠ ব্যবসায়ী সাকের আহমেদ বলেন, ‘আমি বৈধভাবে বেজার দায়িত্বরত কর্মকর্তা শাহীন সরওয়ারের কাছ থেকে গাছ কিনেছি। এরপর সেই গাছ কেটে নিয়ে এসেছি। ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে যাওয়ায় গাছগুলো কেটে বিক্রি করি। প্রতিটি গাছ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দামে কিনেছি। কিছু টাকা পরিশোধও করেছি।’ গাছ কেনার প্রমাণ হিসেবে তিনি বেজার লোগো ও কর্মকর্তার সইযুক্ত রশিদ দেখান। বেজা কর্মকর্তার সঙ্গে কথোপকথনের অডিও রেকর্ডও রয়েছে তার কাছে।

 

স্থানীয়রা বলছেন, গত কয়েক দিনের ব্যবধানে সৈকতের পাড়ে ঝাউ বাগানের অনেক জায়গা থেকে গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে গাছ বিক্রি হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবরাং পার্কের দায়িত্বে থাকা বেজার সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর শাহীন সরওয়ার সোহাগ বলেন, ‘সাগরের ঢেউয়ে পড়ে যাওয়া ঝাউগাছ বিক্রির বিষয়ে স্থানীয় ওই কাঠ ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল। তবে গাছগুলো বিক্রি করা হয়নি। বেজার লোগো ও সই সংবলিত রসিদ ভুয়া। ওই ব্যবসায়ী নকল করে এটি তৈরি করেছেন। গাছ বিক্রির এসব তথ্য মিথ্যা।’

মামুন সমিলে রাখা হয়েছে উপকূল থেকে কাটা ঝাউগাছ

এ ব্যাপারে সাবরাং পার্কের (বেজার) সহকারী পরিচালক তন্ময় হাসান বলেন, ‘বেজার লোগোযুক্ত রসিদে যে সই রয়েছে, সেটি আমার নয়। লোগোযুক্ত কাগজটি বেজার হলেও সই ঠিক নেই। ইতোমধ্যে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। যদি ঝাউবন বিক্রিতে আমাদের কেউ জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

উপকূল বন বিভাগের তথ্যমতে, মেরিন ড্রাইভের লাগোয়া সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের ভেতরে টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত সমুদ্রসৈকতের পাড়ে ৫ হেক্টর বালুচরে ৪০ হাজার ঝাউগাছ লাগানো হয়। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উপকূলীয় জনগণের সম্পদ রক্ষায় এসব গাছ লাগিয়েছিল বন বিভাগ।

এই ঝাউবাগান ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রতিরক্ষা দেয়াল হিসেবে উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষা করে আসছিল বলে জানালেন উপকূল বন বিভাগের টেকনাফ রেঞ্জের কর্মকর্তা বশির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এসব গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া দুঃখজনক। ২০১৫-১৬ সালে বন বিভাগের ৮৮৪ একর জমি বেজাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য ঝাউগাছগুলোও পড়ে। তখন থেকে ওই ঝাউবন রক্ষার দায়িত্ব বেজার। তবে নিয়ম হচ্ছে, গাছ কাটার আগে আমাদের জানাতে হবে। কিন্তু অনেকে না জানিয়ে গাছগুলো কেটে নিয়ে গেছেন।’  

সমিলে ঝাউগাছ কেটে কাঠ বানাচ্ছেন শ্রমিকরা

সাবরাং এলাকার মোহাম্মদ শাহীন বলেন, ‘বেজার অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ঝাউবনের গাছ নির্বিচারে কাটা হচ্ছে। ভোরে ও সন্ধ্যায় এখানে গাছ কাটার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। মূলত ঝাউবন কাটায় সড়কটি দ্রুত ভাঙছে। আমাদের এলাকা প্রবল ঘূর্ণিঝড়প্রবণ। প্রতি বছর বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। উপকূল রক্ষার দেয়াল ঝাউবন উজাড় হলে সবাই ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়বো।’ 

গাছ কাটার বিষয়টি শুনেছি উল্লেখ করে উপকূল বন বিভাগের পাহারাদার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বেজার অধীনে হওয়া ঝাউবন আমরা পাহারা দিই না। উপকূলের বাকি ঝাউবন রক্ষায় রাতদিন পাহারা দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয়রা ঝাউগাছ কাটছে বলে তথ্য পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঝাউবন আমাদের উপকূল রক্ষা করে আসছে। যদি অবৈধভাবে কোনও কর্মকর্তা ঝাউবনের গাছ বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকেন, বেজা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Source link

Related posts

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক

News Desk

ঈদের পর প্রাণ ফিরেছে কক্সবাজার সৈকতে

News Desk

গাছে গাছে ফুটেছে কদমফুল

News Desk

Leave a Comment