করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্থবির হয়ে ছিল টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প। এই সময়ে অসংখ্য তাঁত বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়েন শ্রমিকরা। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ফের কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে তাঁতপল্লী। শাড়ি-লুঙ্গি উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে করোনার পর টাকা ও শ্রমিকের অভাবে এখনও ৬০ শতাংশ তাঁত বন্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার প্রথম ঢেউয়ে তাঁতে কাপড় তৈরিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছিল। এতে করে ওই সময় অসংখ্য তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে পড়েন চরম বিপাকে। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দেন।
এদিকে দীর্ঘ বন্ধের পর রমজানের আগ মুহূর্ত থেকে কিছু কিছু তাঁত খুলতে শুরু করে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তাঁতপল্লীতে পাইকাররা আসা শুরু করেছেন। শাড়ির চাহিদা পূরণ করতে পুরো তাঁতপল্লী এখন কর্মচঞ্চল ও ব্যস্ত সময় পার করছে। তবে এখনও শ্রমিক সংকট ও করোনায় নিঃস্ব হওয়ায় অনেকেই তাঁত চালু করতে পারেননি।
এদিকে, তাঁতশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য জেলার কালিহাতীর বল্লায় (ঘাটাইল, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার জন্য একটি এবং সদর উপজেলার বাজিতপুরে দেলদুয়ার, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখীপুর ও সদর উপজেলার জন্য একটি) বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের দুটি বেসিক সেন্টার রয়েছে। বাতাঁবো’র বাজিতপুর ও বল্লায় এ দুইটি বেসিক সেন্টারের নিয়ন্ত্রণে ৩০ হাজারের উপরে তাঁত রয়েছে। এখনও ৬০ শতাংশ তাঁত বন্ধ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আর বাকি ৪০ শতাংশ তাঁত চালু করা হয়েছে। আবার অনেকেই টাকার অভাবে তাঁত বিক্রিও করে দিয়েছেন।
টাঙ্গাইল সদরের বাজিদপুর, দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডী, নলশোধা, ধুলটিয়া, কালিহাতীর বল্লা রামপুরে তাঁতের শাড়ি তৈরি হলেও দেলদুয়ারের চন্ডী-পাথরাইল মূলত তাঁতপল্লী হিসেবে পরিচিত। এখানকার উৎপাদিত তাঁতের শাড়ি সারাদেশের চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরেও রফতানি হয়। এখানে রাতভর কাজ করেও তাঁতশ্রমিকদের ক্লান্তি নেই। উৎপাদন যত বেশি হবে, সাপ্তাহিক বিল ততো বেশি পাওয়া যাবে। সুতা রঙ করা থেকে শুরু করে শাড়ি বিক্রি, সব কাজই ধাপে-ধাপে পরিবারের সব বয়সের সদস্যরা মিলে করছে।
বর্তমানে উৎপাদন ও বাজার উভয়ই ভালো যাচ্ছে। ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারে নেমেছে নতুন কারুকাজের শাড়ি। ভিন্ন বুটি আর নতুন নকশায় তৈরি এই শাড়ি শুধু ঈদ উৎসবের জন্য।
পাথরাইল এলাকার তাঁতি রাম রাজবংশী বলেন, ‘আমার ১৩টি তাঁত ছিল। এখন ৮টি চালু করেছি। টাকার অভাবে বাকিগুলো চালু করতে পারিনি। সুতাসহ প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। এ পেশা ধরে রাখতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। সরকারিভাবে ঋণ পেলে হয়তো আগের অবস্থানে ফিরে যাওযা যেতো।’
তাঁতশ্রমিক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আগের চেয়ে বর্তমান পরিস্থিতি ভালো। লকডাউনে বেকার ছিলাম। পরিবার নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এখন তাঁত চালু হয়েছে। এজন্য আবার কাজে এসেছি। আগের তুলনায় কাপড় তৈরিতে মজুরি ৩-৪শ’ টাকা কম দিচ্ছে। তারপরও আমরা সংসার চালাতে কাজ করে যাচ্ছি।’
আব্দুল বাছেদ বলেন, ‘আগে শাড়ি তৈরির মজুরি ছিল ১২০০ টাকা। আর এখন ৮০০ টাকা দিচ্ছে। প্রতি কাপড়ে ৩-৪শ’ টাকা কম দিচ্ছে। মহাজনে ঠিকমতো কাপড় বিক্রি করতে পারলে আমাদের কাজ দেয়। আর বিক্রি করতে না পারলে আমাদের কাজ দেয় না। এভাবেই চলছে।’
পাথরাইল এলাকার তাঁতশ্রমিক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘জামদানি শাড়ি তৈরির মজুরি আগে ১২০০ টাকা ছিল। এখন ৯০০টাকা দিচ্ছে। প্রতি কাপড়ে ৩০০ টাকা কম।’
টাঙ্গাইলের সবচেয়ে বড় শাড়ির হাট ঘুরে দেখা যায়, তাঁতিরা উৎপাদিত কাপড় নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। স্থানীয় ও দূর থেকে আসা অধিকাংশ ক্রেতাদের চাহিদা এখন টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। মূল্যসীমা হাতের নাগালে রয়েছে বিভিন্ন সুতি শাড়ির। এছাড়া সিল্ক, সপসিল্ক, রেশন ও দুতারের মধ্যেও রয়েছে উন্নতমানের টাঙ্গাইল শাড়ি। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা।
শাড়ি ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও দেশের বাইরে থেকেও শাড়ি কিনতে লোকজন ভিড় জমায়। এখন করটিয়া হাটে শাড়ির চাহিদা রয়েছে ভালোই। দীর্ঘদিন পর বেচা-কেনা ভালো হচ্ছে।’
শাড়ি ব্যবসায়ী উত্তম কুমার বলেন, ‘করোনার কারণে দীর্ঘদিন হাটে তেমন কাপড় বিক্রি হয়নি। এখন সব স্বাভাবিক থাকায় চাহিদা রয়েছে। এজন্য তাঁতিরাও শাড়ি তৈরি করছেন। হাটে বেচা-কেনাও ভালো হচ্ছে।’
টাঙ্গাইলে শাড়ির রাজধানী হিসেবে খ্যাত চন্ডী-পাথরাইল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর আবার তাঁতপল্লীতে খটখট শব্দ শুরু হয়েছে। এখন জেলায় ৪০ শতাংশ তাঁত চলছে। শ্রমিক ও টাকার অভাবে ৬০ শতাংশ তাঁত এখনও বন্ধ। এই ৪০ শতাংশ তাঁত দিয়েই তাঁতিরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। ঘরে আটকে থাকা কাপড়গুলো ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। এখন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার ঈদকে সামনে রেখে কাপড় তৈরির কাজ চলছে।’ এ পেশা ধরে রাখতে সরকারিভাবে তাঁতিদের ঋণ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের টাঙ্গাইলের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘যারা এই তাঁত পেশাটা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা যেন আবার ফিরে আসতে পারে সেজন্য বোর্ড বড় রকমের ঋণ সুবিধা দিতে কাজ করছে।’