এবার এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন রংপুরের সালামত উল্লাহ। ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে মাথায় হাত। প্রতি কেজি ১২ টাকা দরে বিক্রি করছেন। অথচ কেজিতে খরচ পড়েছে ২০ টাকার মতো। এতে লাভের আশা তো দূরের কথা, চাষের দেনা পরিশোধ নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। শুধু সালামত নন, আলু চাষ করে এবার জেলার হাজারো কৃষক এখন লোকসানের মুখে পড়েছেন।
আলু চাষিরা বলছেন, এবার বীজ ও সারের দাম বেশি হওয়ায় প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছে ১৯-২০ টাকা। সেই আলু ১১-১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি লোকসানে পড়তে হচ্ছে তাদের। অথচ খুচরা বাজারে এখনও প্রতি কেজি ২০-২৫ টাকায় বিক্রি হয়। তারা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। মাঝখানে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। এ অবস্থায় হাজারো কৃষককে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।
রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় চলতি মৌসুমে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমি। অতীতের রেকর্ড ভেঙে চাষ হয়েছে ৬২ হাজার ২৮০ হেক্টরে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত আবাদ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। তবে তা ২০ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে।
যা বলছেন চাষিরা
সদরের বিভিন্ন এলাকার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাভের আশায় এবারও চাষিরা নানা জাতের আলু চাষ করেছেন তারা। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের শেষে আলু রোপণ করে নভেম্বরে তা বাজারে বিক্রি করা হয়। তবে এবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বৃষ্টির কারণে বীজ নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে নতুন বীজ রোপণ করতে হয়। এতে অন্যান্য বছরের তুলনায় চাষের খরচ বেড়েছে। কিন্তু এখন বিক্রি করে লোকসানে পড়ছেন।
কৃষকরা জানান, গত মৌসুমে প্রতি কেজি আলুর দাম উঠেছিল ৭০-৮০ টাকা পর্যন্ত। তাতে এক কমবেশি সবাই লাভবান হয়েছেন। সেই আশায় এবার বেশি জমিতে আবাদ করেছেন। এবার মৌসুমের শুরুতেই প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৯০ টাকায়। এখন মাঠে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ১১ থেকে ১২ টাকায়।
আলু চাষি সালামত উল্লাহ বলেন, ‘এবার এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে খরচ পড়েছে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এখন আলু বিক্রি করে ১২ হাজার টাকাও উঠেছে না। এক বিঘায় উৎপাদন হয়েছে ৫০ বস্তা। প্রতি বস্তায় ৭০ কেজি থাকে। ১১ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে।’
মাহিগঞ্জ এলাকার মমতাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত মৌসুমের এই সময়ে ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করেছি। এবার তার অর্ধেক দামও মিলছে না। আমাদের প্রচুর লোকসান হচ্ছে।’
পীরগাছার সোলায়মান ও আব্দুর রহিম জানান, বেশি লাভের আশায় ঋণ করে দুজনে দুই একর জমিতে আলু চাষ করেছেন। এখন লাভের আশা তো দূরের কথা, ঋণের টাকা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
আব্দুর রহিম বলেন, ‘এই আলু হিমাগারে রাখতে গেলেও খরচ বেশি। কারণ হিমাগারের খরচ এবার বাড়ানো হয়েছে। সেখানেও রেখেও যদি পরে দাম না পাই সে ভয়ে এখনই বিক্রি করে দিতে হচ্ছে।’
রংপুর সিটি বাজার পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আক্কাছ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনি না। পাইকারি হাট থেকে কিনি। সেখান থেকে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ বাদ দিয়ে দুই-তিন টাকা লাভে বিক্রি করে দিই। তবে এটা সত্য, এবার কৃষকরা আলুর ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। কারণ বাজারে দাম কম। কয়েক হাত বদলে ১১-১২ টাকার আলু খুচরা বাজারে ২০ টাকায় বিক্রি হয়।’
কৃষি বিভাগের ভাষ্য
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুরের উপপরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার রেকর্ড পরিমাণ জমিতে আলু চাষ হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় আশানুরূপ ফলন হয়েছে। জেলায় সারা বছরে আলুর চাহিদা দুই থেকে আড়াই লাখ মেট্রিক টন। এবার জেলার চাহিদা মিটিয়ে ১৫ লাখ টনের বেশি দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো যাবে। মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশ আলু নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ফলে রংপুর থেকে রফতানি করা যাবে। তবে চাষিরা যদি ন্যায্য মূল্য না পান তাহলে লোকসান গুনতে হবে। সেক্ষেত্রে আলু চাষে আগ্রহ হারাবেন তারা। এজন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।’