অস্তিত্ব সংকটে নেত্রকোনার নদ-নদী, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য
বাংলাদেশ

অস্তিত্ব সংকটে নেত্রকোনার নদ-নদী, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর অধ্যুষিত নেত্রকোনা জেলা। একসময় নদী পথই ছিল জেলার মানুষের যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু কালের বিবর্তনে নদীপথ প্রায় বিলীন। বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক নদীও। বর্তমানে যে কয়েকটি নদ-নদী আছে, সেগুলোও রয়েছে অস্তিত্ব সংকটে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে নদীনির্ভর কৃষি অর্থনীতিসহ সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায়। সেইসঙ্গে হুমকিতে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।

নদ-নদীর এমন দুর্দশার জন্য আন্তঃসীমান্ত নদী প্রণালি ঠিক না রাখা, দীর্ঘদিন নদীগুলো খনন না করা, পাহাড়ি ঢল এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে দায়ী করছেন নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জেলায় সাতটি বড় নদীসহ ১২২টি ছোট-বড় নদী ও খাল ছিল। বড় সাত নদী হলো সোমেশ্বরী, কংস, মগড়া, উব্দাখালী, ধনু, ভোগাই ও গুমাই। এগুলোর দৈর্ঘ্য ৩৩৪ কিলোমিটার। ছোট-বড় ১১৫টি নদীর দৈর্ঘ্য ৫১২৫.৬ কিলোমিটার। বর্তমানে এগুলো খালে পরিণত হয়েছে। 

সদর উপজেলায় ১৮টি খাল রয়েছে। সেগুলো হলো- হরিখালি, নাপিতখালি, ডুপিংখালী, মগড়া, খোশাই, ঝিটাই, রেজখালী, গুরিয়ার, নগুয়া, ঠাকুরকোণা, চুচিয়া, ধলাই, দরিজাগি, সিদলী, জাহাঙ্গীরপুর, বালচ, মরাখালী ও তিলকখালী খাল। দুর্গাপুর উপজেলায় নালিয়া আগা, ছুখাইখালী, বালচ, ঝিনাইগাতি, আরবাখালী, নাহিতখালী, সত্তর মুন্সি, বানেস্বরী ও পাগরিয়া নামে ৯টি ছোট-বড় খাল রয়েছে। কলমাকান্দায় জাঙ্গার, গুতুরা, সিদ্ধখলা, আরিন্দাখালী, গোবিন্দপুর, বড়ইউন্দু, গোলামখালী, মান্দাউড়া, মহাদেব, বাইন বিল, শ্যামপুর, গুমাই, দিলুরা ও ভোগাইসহ কয়েকটি নদ-নদী আছে। কেন্দুয়ায় ১৬টি নদী ও খাল রয়েছে। সেগুলো হলো- রাজি, সাইডুলি, পাটেশ্বরী, হুচিয়া, তুরুকপাড়া, ডুমরি, রাজপত, ওয়াই, চরপুর, সান্দিকোণা, কলতরিল, কুরদিঘা, সুতি, কচন্দরা, বালকি ও সামুকজানি। বারহাট্টায় ২৬টি খাল রয়েছে। সেগুলো হলো মরা কংশ, মরা বিশনাই, বড় ধলা, ঘালিয়ামারি, নানিয়া চাটগাঁও, নয়া বিল, পিয়াইন, দত্তখিলা, ঘাবারকান্দা, বারই, আমতলা, চাপারকোনা, ধলেশ্বরী, বাঘাইর, মহেশখালী, ধলা, গুলামখালী, রৌহা, নন্দী বাড়ি, বড়াপাড়া, টংগা, কান্দাপাড়, বড়িখাল, কামালপুর, শিববাড়ী ও বালিজুড়ী। পূর্বধলায় ১১টি খাল হলো- কালিহর, বালিয়া, লাউয়ারী, ফলাখালী, খসখসিয়া, বারাবারির, ধলাই, মরা, পাছুয়া, বলজানা ও সুয়াইর। মোহনগঞ্জে সাতটি খাল হলো- ঘোড়াউত্রা, মরা ধলাই, বেলদরিয়া, দাইরের, কলুংকা, পাপমারা ও নৌকা ভাঙা। খালিয়াজুরীতে সাতটি নদী ও খালের মধ্যে রয়েছে বিশ্বহরি ডুলিয়াজান, ডুলনিরখাল, সেলা, পুটিয়া, নাইয়রী, বয়রা ও বৌলাই। মদন উপজেলায় পাঁচটি খাল হলো বালুই, বয়রাহালা, নাসিরখালী, পাতুনিয়া, আন্দারমানিক এবং আটপাড়া উপজেলা দুটি খাল হলো পাগলাখালী ও পঞ্চখালী।

এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এসব নদী-খালের বিভিন্ন অংশ দখলে নিয়ে বাঁধ দিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ ধরে ধান চাষ করছেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব থাকায় সচেতন মহলের ধারণা, জনগণ একদিকে নদীর উপকারিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অপরদিকে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে।

কংস, মগড়া, সোমেশ্বরী, উব্দাখালী ও ধনু নদীর দুই পাড়ের কয়েকজন কৃষক জানিয়েছেন, তারা আগে নদীর পানি দিয়ে সারা বছর গৃহস্থালির কাজ করতেন। বোরো ফসলের মাঠে সেচ দেওয়ার চিন্তা করতে হতো না তাদের। অথচ এখন আর জমিতে সেচ দেওয়ার মতো পানি নেই। সব নদী-খাল ভরাট হয়ে গেছে। 

সদর উপজেলার কৃষক জাকির হোসেন ও দুর্গাপুরের আলমগীর হোসেন জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগেও তাদের এলাকার জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু প্রভাবশালী মহল ইতিমধ্যে নদী-খালগুলো দখলে নিয়েছে। দুই তীরে যাদের জমি আছে তারাই নদী দখলে নিচ্ছে। যাদের জমি নেই তারাও ধান লাগানোর অজুহাতে দখল করছে। কেউ কেউ সুবিধা অনুযায়ী নদী থেকে বালু তুলে অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। আবার অনেক স্থানে অবৈধভাবে ইটের ভাটা বসিয়ে বালুর ব্যবসা করা হচ্ছে। 

নেত্রকোনার পরিবেশকর্মী মো. অহিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলার সব নদ-নদী এখন খালে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ খাল দখল হয়ে গেছে। এগুলো উদ্ধার করা না গেলে জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়বে।’

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারোয়ার জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলার তিনটি নদী ও বেশ কয়েকটি খাল খননের কাজ চলমান আছে। আরও ২৪টি খাল খননের প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে সেগুলোর কাজ শুরু হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘যেসব নদ-নদী ও খাল খননের প্রয়োজন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে তার একটি তালিকা তৈরি করে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। নদী ও খালের জায়গা থেকে সব ধরনের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হবে।’

Source link

Related posts

পুলিশের সাঁজোয়া যান সাজছে রণসাজে

News Desk

শাটডাউনে রণক্ষেত্র গোটা দেশ

News Desk

ফেরিঘাটে ভিড় সংক্রমণের হার আবারও বাড়িয়ে দিতে পারে

News Desk

Leave a Comment