সৈয়দপুর থেকে পোশাক রফতানি অর্ধেকে নেমেছে
বাংলাদেশ

সৈয়দপুর থেকে পোশাক রফতানি অর্ধেকে নেমেছে

নীলফামারীর বাণিজ্যিক উপজেলা সৈয়দপুরের রফতানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস থেকে পোশাক রফতানি অর্ধেকে নেমেছে। বিশেষ করে ভারত সরকার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাকসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় সৈয়দপুরের ঝুটভিত্তিক পোশাক ব্যবসায় বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। ফলে এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা বেকায়দায় পড়েছেন। পোশাক তৈরির সঙ্গে জড়িত একাধিক উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সৈয়দপুর রফতানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক শিল্প সমিতি সূত্রে জানা গেছে, এখানের দুই শতাধিক কারখানায় ঝুট থেকে তৈরি পোশাকের রফতানি অর্ধেকে নেমেছে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি সংকটে পড়ছে। কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন অনেকে। কারখানাগুলোতে তৈরি হওয়া ট্রাউজার, শর্টস, জ্যাকেট, টি-শার্ট, জিনসের প্যান্টসহ নানা ধরনের পোশাক স্থানীয় বাজারে সরবরাহের পাশাপাশি ভারত, ভুটান ও নেপালে রফতানি হতো। কিন্তু এবার ভারতের নিষেধাজ্ঞায় স্থলপথে রফতানি বন্ধ আছে। ব্যবসায়ী ও কারিগররা আর্থিক সংকটে পড়েছেন।

সমুদ্রপথে রফতানি কঠিন 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সমুদ্রপথে রফতানি কঠিন হয়ে পড়েছে। পরিবহন ব্যয় বেড়েছে তিন গুণ। পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগছে ২০-২৫ দিন। এটি সমাধানে সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন তারা।

সৈয়দপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সৈয়দ মনজুর হোসেন বলেন, ‘২০২২-২৩ সালে এসব পোশাকের বড় অংশ রফতানি হতো ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে। দেশ-বিদেশ মিলে ৪০ কোটি টাকার বেশি পোশাক বিক্রি হতো। কিন্তু গত মে মাসে ভারত সরকার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাকসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় রফতানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সমুদ্রপথে কিছু পণ্য পাঠানো হয়। তাতে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। সময়ও লাগছে ২০ দিনের বেশি। অর্ধেকে নেমেছে বিক্রি। এজন্য লোকসানের মুখে পড়েছেন শ্রমিক, ব্যবসায়ী, কারিগর ও উদ্যোক্তারা। এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করা জরুরি।’

মূল কারণ এবং প্রভাব

ভারত সরকার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাকসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় মূলত সৈয়দপুরের ঝুটভিত্তিক পোশাকশিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। আগে বেনাপোল, সোনামসজিদ এবং সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রফতানি হতো। এখন সমুদ্রবন্দর দিয়ে রফতানি করতে হচ্ছে। যার ফলে পরিবহন খরচ তিনগুণ বেড়েছে। স্থলপথে সেখানে পণ্য পৌঁছাতে লাগছে ২০-২৫ দিন।

ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও কারিগররা বলছেন, সৈয়দপুরে ঝুট কাপড়ের ব্যবসা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। কে প্রথম শুরু করেছিলেন, তা নিশ্চিত নয়। তবে শুরু থেকেই ঝুট থেকে তৈরি হয়ে আসছে নানা ধরনের পোশাক। ২০০২ সাল থেকে এর বিস্তার বাড়তে থাকে। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার পোশাক কারখানা থেকে ঝুট কাপড় সংগ্রহ করেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি সুতা, বোতাম, ইলাস্টিক, প্যান্টের পকেটের স্টিকার, পুরোনো সেলাই মেশিনও সংগ্রহ করা হয়। এসব দিয়ে তৈরি হয় ট্রাউজার, শর্টস, জ্যাকেট, টি-শার্ট, জিনসসহ বিভিন্ন পোশাক। এসব পোশাকের চাহিদা বাংলাদেশে যতটা, তার চেয়ে বেশি ভারত, নেপাল ও ভুটানে। বর্তমানে অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার সরাসরি এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। প্রায় প্রতিটি বাড়িই এখন ছোট পোশাক কারখানায় পরিণত হয়েছে। কোথাও দুটি, কোথাও আবার ৫০ থেকে ১০০টি মেশিনে সারা বছর কাজ চলছে। উৎপাদিত পোশাক দেশের বাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশে। আমদানি কমায় উৎপাদনও কমে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে শত শত পরিবারের জীবন-জীবিকা।

দুই শতাধিক কারখানায় একই চিত্র

সৈয়দপুরের পৌর এলাকার মুন্সীপাড়া, সাহেবপাড়া, নয়াটোলা, কয়ানিজপাড়া, হাতিখানা, মিস্ত্রিপাড়া, নতুন বাবুপাড়া, পুরাতন বাবুপাড়া, গোলাহাট, রাবেয়া মোড়, ঘোড়াঘাট, বোতলাগাড়ী, বাঁশবাড়ী, নিয়ামতপুর, চাঁদনগরসহ গ্রামের বেশিরভাগ ঘরেই গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক ক্ষুদ্র পোশাক কারখানা। সর্বনিম্ন দুটি থেকে সর্বোচ্চ ১০০টি মেশিনও আছে একেক কারখানায়। বর্তমানে বেশিরভাগ কারখানায় উৎপাদন কমেছে। এখন তৈরি শীতের পোশাক বিদেশে রফতানি করতে না পেরে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিটি জ্যাকেট ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রফতানির পথ বন্ধ হওয়ায় খরচ বেড়েছে তিন গুণ

ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৭ মে এক আদেশে জানায়, তৈরি পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এখন থেকে কেবল কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়েই আমদানি করা যাবে। ব্যবসায়ীরা জানান, আগে সৈয়দপুর থেকে বেনাপোল, সোনামসজিদ ও সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে পোশাক রফতানি হতো। আগে যে পরিমাণ পোশাক ভারতে রফতানিতে খরচ হতো ২০ হাজার টাকা, এখন কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়ে তা রফতানির খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার। অর্থাৎ পরিবহন ব্যয় বেড়েছে তিন গুণ। ফলে শুধু বাজারে টিকে থাকার জন্য অনেকে এখন ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন চালাচ্ছেন। স্থানীয় বাজারে কিছু পোশাক বিক্রি করে কোনোমতে চলছেন। 

অর্ধেকে নেমেছে অর্ডার

শহরের নয়াটোলা মহল্লার এইচ আর গার্মেন্টসের মালিক হামিদুর রহমান বলেন, ‘চলতি বছর ৫০ লাখ টাকার অর্ডার পেয়েছি। অথচ ২০২৪ সালের আগে প্রায় প্রতিটি শীত মৌসুমে কোটি টাকার বেশি অর্ডার পেয়েছিলাম। অর্ডারকৃত শীতবস্ত্র নভেম্বরের শেষে পাঠানো হতো ভারত, ভুটান ও নেপালে। কিন্তু এখন পাঠানো যাচ্ছে না। বর্তমানে স্থানীয় বাজারে চাহিদা থাকায় কয়েকজন কারিগর দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বাকি কারিগর ও শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারায় ছেড়ে দিয়েছি। প্রায় প্রত্যেক কারখানায় একই চিত্র।’

নিয়ামতপুরের নিমবাগান মহল্লার জ্যাকেট কারখানার মালিক রনো বলেন, ‘আধুনিক ৫০টি সেলাই মেশিন নিয়ে একটি মাঝারি কারখানা নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছিলাম। একেকজন শ্রমিক দিনে আট থেকে ১০টি জ্যাকেট তৈরি করেন। এতে তারাও ভালো মজুরি পেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। পাশাপাশি আমরা খরচ মিটিয়ে লাভের মুখ দেখতাম। আমার কারখানায় তৈরি জ্যাকেট ভারতের শিলিগুড়িতে পাঠাতাম। চলতি শীত মৌসুমে উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। কারণ ভারতে রফতানি না হওয়ায় উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এতে করে শ্রমিকদের কাজ কমে গেছে। অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। আমাদেরও লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

ব্যবসায় একপ্রকার ধস

সৈয়দপুর রফতানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক শিল্প সমিতির এক নেতা জানিয়েছেন, দুই শতাধিক কারখানায় পাঁচ-ছয় হাজার নারী-পুরুষ কর্মরত। সবশেষ ২০২৩ সালে শীত মৌসুমে এখানকার ব্যবসায়ীরা ৪০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিলেন। এরপর পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে গেলো। ভারত সরকার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাকসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় এখানকার ব্যবসায় একপ্রকার ধস নেমেছে। এবার শীত মৌসুমে ২০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলেও মনে হয় না। 

স্থানীয় দোকানেও বিক্রি হয় সৈয়দপুরের গার্মেন্টসে তৈরি পোশাক

সৈয়দপুর রফতানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহীন আক্তার বলেন, ‌‘মূলত শীত মৌসুমেই এখানকার পোশাক বেশি বিক্রি ও রফতানি হতো। এবার শীত মৌসুমে স্থানীয়ভাবে কিছু অর্ডার পাওয়া গেছে। যা কয়েক কোটি টাকার হবে। হবে সেটি ২০ কোটিও হবে না। এখানের বেশিরভাগ কারখানা রেলের জমিতে গড়ে উঠায় আর্থিক সংকটে পড়লে ঋণ দিতে চায় না ব্যাংকগুলো। ফলে অনেক ব্যবসায়ী অর্থের অভাবে ব্যবসায় টিকতে পারছেন না। এসব বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি দেওয়ার অনুরোধ জানাই।’

বিপাকে রফতানিকারকরাও 

সৈয়দপুর থেকে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে পোশাক রফতানি করে তাদের মধ্যে অন্যতম ইনভেন্ট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মালিক হুমায়ুন কবির ৩২ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণত ঝুট কাপড়ের তৈরি ট্রাউজার, জ্যাকেট ও শর্টস রফতানি করি। পাবনায় আমাদের একটি কারখানা আছে, যেখানে মূলত টি-শার্ট তৈরি হয়। সব মিলিয়ে বছরে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার পোশাক ভারত, নেপাল ও ভুটানে রফতানি করতাম। কিন্তু ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন স্থলপথে কোনও পণ্য রফতানি সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রায় শতভাগই ভারতে যায়। এখন কেবল কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়ে রফতানি করা যাচ্ছে। এতে খরচ বেড়েছে অন্তত তিন গুণ, সময় ও ভোগান্তিও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের রফতানি অন্তত ৫০ শতাংশ কমে গেছে।’

আরেক রফতানিকারক ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য বড় ধাক্কা। অনেক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। শুধু স্থলবন্দর দিয়ে রফতানি নিষেধাজ্ঞার কারণে কারখানাগুলো এখন স্থবির হয়ে পড়েছে।’ 

অর্থনীতিতেও বড় ধাক্কা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে প্রায় ১৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকার পণ্য রফতানি করেছিল। আগের অর্থবছরে এই অঙ্ক ছিল ১৭ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। ভারত বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম বাজার, যেখানে বছরে প্রায় ৭০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়। এর মধ্যে ৯৩ শতাংশই যায় স্থলপথে। ফলে নিষেধাজ্ঞা গার্মেন্টস খাতে বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। 

সৈয়দপুর রফতানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক শিল্প সমিতির সহসভাপতি আরশাদ আমির পাপ্পু বলেন, ‘মূলত ভারত সরকারের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞা এই শিল্পকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বিপাকে পড়েছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দুই দেশের সরকারকেই ভাবতে হবে। সংকট সমাধান হলে দুই দেশেরই লাভ।’

Source link

Related posts

পরিবার-প্রেমিকাকে হারিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন, অমানবিক নির্যাতনে কাটলো শেষ দিন

News Desk

জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার এখন সময়ের দাবি: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

News Desk

সাতক্ষীরায় আম গাছ থেকে গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

News Desk

Leave a Comment