Image default
জানা অজানা

ডেড সি বা মৃত সাগর : জর্ডান

ডেড সি একটি অতি লবণাক্ত পানি সমৃদ্ধ সাগর। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪২০ মিটার (১,৩৭৮ ফিট) নিচে এটি পৃথিবীর নিম্নতম স্থলভূমি। এটির অবস্থান জর্ডানে। ইচ্ছা করলেও এ পানিতে ডুবা যায় না। জিবুতির আসাল হ্রদের পর এটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লবণাক্ত পানির প্রাকৃতিক আধার | সমুদ্রের পানির চাইতে ৮.৬ গুণ বেশি লবণাক্ত । সাগর বলা হলেও এটি মূলত একটি লেক যার সর্বোচ্চ গভীরতা ১,২৪০ ফুট। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থ সর্বোচ্চ ১৫ কিলোমিটার। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে , মহাসাগরের পানির মহাসাগরের পানির চেয়ে মৃত সাগরের পানিতে থাকা খনিজ উপাদানগুলোর অনেক পার্থক্য রয়েছে। এ সাগরে ১৪% ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ৪% পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড এবং ৩০% সোডিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে। উচ্চ প্লবতার দরুন যে কেউ মৃত সাগরের পানিতে ভেসে থাকতে পারে। এ হ্রদে কোন উদ্ভিদ বা মাছ বাঁচে না বলেই একে মৃত সাগর বলা হয়। সামান্য কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক অণুজীবের সন্ধান পাওয়া যায় এ সাগরে।

মৃত সাগর ; ছবি : cloudfront

ডেড সি’র পশ্চিমে পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েল, পূর্বে জর্ডান অবস্থিত। জিবুতির আসাল হ্রদের পর এটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লবণাক্ত পানির প্রাকৃতিক আধার। এটি পৃথিবীর ৩১.২০ অক্ষাংশ ও ৩৫.২০ দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। ৭০,০০০ বছর পূর্ব থেকে ১২,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত ডেড সি’র পানির উচ্চতা বর্তমান উচ্চতার চাইতে ১০০ থেকে ২৫০ মিটার বেশি ছিল। ২৬,০০০ বছর পূর্বে এটির পানি সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে। প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে এর পৃষ্ঠ উচ্চতা হ্রাস পেতে শুরু করে, যা সম্ভবত বর্তমান পৃষ্ঠ উচ্চতার চাইতেও অনেক কম ছিল।গত কয়েক হাজার বছর ধরে এর পানির পৃষ্ঠ উচ্চতা মোটামুটি ৪০০ মিটারের আশেপাশে অবস্থান করছে।

প্রায় তিন মিলিয়ন বছর পূর্বে বর্তমান জর্দান নদী, মৃত সাগর এবং ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগরের পানিতে বারবার প্লাবিত হত। এর ফলে একটি সরু উপসাগরের সৃষ্টি হয়। উপসাগরটি জেজরিল উপত্যকায় একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত ছিল ।

প্রাকৃতিক তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে উপত্যকা এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগ যথেষ্ট উচ্চতা লাভ করে। ফলে মহাসাগরের প্লাবনে এই অঞ্চলে সৃষ্ট উপসাগরটি পরিবেষ্টিত হয়ে হ্রদে পরিণত হয়।

ডেড সি ; ছবি : উইকিপিডিয়া

বর্তমানে মৃত সাগর অঞ্চলটি চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণাস্থল হয়ে উঠেছে। এর মূলে রয়েছে হ্রদের পানিতে খনিজ দ্রব্যাদির বিপুল উপস্থিতি, বাতাসে এলার্জি উৎপাদক দ্রব্য এবং পরাগরেণুর স্বল্পতা, উচ্চ ভূ-মণ্ডলীয় চাপ, সৌর বিকিরণে অতি বেগুনি উপাদানের কম উপস্থিতি। উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা রোগীদের জন্য বেশ উপকারী। চর্মরোগ সোরিয়াসিস এর জন্য দীর্ঘসময় সূর্যস্নান বেশ উপকারী। এ অঞ্চলে অতি বেগুনি রশ্মির স্বল্পতা সূর্যস্নানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া রোগটি নিরাময়ে জন্য মৃত সাগরের লবণও বেশ উপকারী বলে বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় দাবী করা হয়েছে।

ডেড সি প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই সাগর থেকে মূল্যবান সম্পদ সংগ্রহ করে থাকে। ২০০১ সালে মৃত সাগর থেকে প্রাপ্ত ব্রাইন থেকে ইসরায়েল ১.৭৭ মিলিয়ন টন পটাশ , ৪৪,৯০০ টন কস্টিক সোডা , ২০৬,০০০ টন ব্রোমিন এবং ২৫,০০০ টন ম্যাগনেসিয়াম ধাতু এবং সোডিয়াম ক্লোরাইড উৎপাদন করে । জর্ডান প্রান্তে ১৯৫৬ সালে স্থাপিত হয় আরব পটাশ বা এপিসি । এটি বাৎসরিক উৎপাদন করে ২ মিলিয়ন টন পটাশ । এছাড়া উৎপাদিত হয় ম্যাগনিসয়াম ও সোডিয়াম ক্লোরাইড।

ডেড সি’তে কোনো মাছ নেই, কারণ এই সাগরের পানিতে কোনো মাছ বাস করতে পারে না। তেমনিভাবে এর পাশে জর্ডান নদীতেও কোনো মাছ নেই। এই সাগরের পানিতে কোন উদ্ভিদ বা মাছ বাচতে পারে না বলেই মূলত এই সাগরকে ডেড সি বা মৃত সাগর বলা হয়ে থাকে। এই সাগরের পানিতে শুধুমাত্র সামান্য কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক অণুজীবের সন্ধান পাওয়া যায়। ডেড সি তীরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে উট, খরগোশ, খেঁকশিয়াল এমনকি চিতাবাঘ দেখতে পাওয়া যায়। অতীতে জর্ডান নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে প্যাপিরাস এবং পাম গাছে সমৃদ্ধ বনভূমি ছিল। রোমান এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সময় ইক্ষু, সিকামোর এবং হেনা এ অঞ্চলের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল। জেরিকোতে বেলসাম গাছের রস থেকে প্রস্তুত করা হত উন্নত মানের পারফিউম এবং সুগন্ধি।

ডেড সি ; ছবি : factsbd

ডেড সি বর্তমানে একটি পর্যটন কেন্দ্র। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পর্যটক ডেড সি দর্শন করতে আসে। তারা ডেড সি’র পানিতে নেমে সাতার কাটে, ডুবে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। অনেকে আবার এই সাগরের পানিতে শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ে সময় কাটায়। অনেকের মাঝে বিশ্বাস আছে যে, এই সাগরের মাটিতে রোগ নিরাময়ের উপাদান আছে, সেজন্য অনেকে এখানে এসে সাগরের মাটি সমগ্র শরীরে লাগায়। উনিশ শতকে জর্ডান নদী এবং মৃত সাগরটি ১৮৩৫ সালে ক্রিস্টোফার কস্টিগান, ১৮৪৭ সালে থমাস হাওয়ার্ড মলিনেক্স, ১৮৪৮ সালে উইলিয়াম ফ্রান্সিস লিঞ্চ এবং ১৮৬৯ সালে জন ম্যাকগ্রেগর ডব্লিউএফ লিঞ্চের ১৯৪৯ বইয়ের সম্পূর্ণ পাঠ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান ‘জর্ডান নদী এবং মৃত সাগরের অভিযান’ অনলাইনে পাওয়া যায়। চার্লস লিওনার্ড ইরবি এবং জেমস ম্যাঙ্গেলস ১৮১৭-১৮ সালে ইতিমধ্যেই মৃত সাগরের তীরে ভ্রমণ করেছিলেন, কিন্তু এর জলে চলাচল করেননি। গবেষকরা এবং বিজ্ঞানীরা খনিজ পদার্থ বিশ্লেষণ করতে এবং অনন্য জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করতে এসেছিলেন। ১৮৬৮ সালে মৃত সাগরের পূর্বে মালভূমিতে “মোয়াবাইট পাথর ” খুঁজে পাওয়ার পর , মোসা উইলহেলম শাপিরা এবং তার সঙ্গী সেলিম আল-খৌরি জালিয়াতি করেছিলেন এবং অনুমিত “মোয়াবাইট” পুরাকীর্তির একটি সম্পূর্ণ পরিসর বিক্রি করেছিলেন এবং ১৮৮৩ সালে শাপিরা যা উপস্থাপন করেছিলেন বর্তমানে “শাপিরা স্ট্রিপস” নামে পরিচিত, চামড়ার স্ট্রিপগুলিতে লেখা একটি অনুমিত প্রাচীন স্ক্রোল যা তিনি দাবি করেছিলেন যা মৃত সাগরের কাছে পাওয়া গেছে। স্ট্রিপগুলি জালিয়াতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং শাপিরা অপমানের সাথে তার নিজের জীবন নিয়েছিল। ১৯৪০ -এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৫০ -এর দশকের গোড়ার দিকে, ১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী শত শত ধর্মীয় নথিপত্র মৃত সাগরের উত্তর -পশ্চিম তীর থেকে প্রায় এক মাইল (১.৬ কিলোমিটার) অভ্যন্তরে কুমারানের প্রাচীন বসতির কাছে গুহায় পাওয়া যায়। পশ্চিম তীর). তারা মৃত সাগর স্ক্রোলস হিসাবে পরিচিত এবং বিখ্যাত হয়ে ওঠে।বিশ্বের সর্বনিম্ন রাস্তা, হাইওয়ে ৯০, মৃত সাগরের ইসরায়েলি এবং পশ্চিম তীরের তীরে, জর্ডানের পাশে ৩৯৩ মি (১,২৮৯ ফু) সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে।

ডেড সি ; ছবি : amazonaws

হযরত লুত (আঃ) এর জাতি পার্থিব উন্নতির চরম উৎকর্ষে পৌছে যাওয়ার কারণে বিলাসিতার অতিশয্যে সীমালঙ্ঘনের দিক দিয়ে তাদের পূর্বের গযবপ্রাপ্ত জাতিগুলোকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এ জাতি অবিচার তো করতোই, তার উপর সমকামিতার মত চরম সীমালঙ্ঘনও তারাই প্রথম শুরু করে, যা তাদের পূর্বে কেউ কখনো করে নি। উপরন্তু, তারা এর ফলে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত না হয়ে গর্ব করে তা সমাজে প্রকাশ করে বেড়াত এবং প্রকাশ্যে ও নির্লজ্জভাবে এসব নিষিদ্ধ কাজগুলো করত। আল্লাহ তাআলা তাই হযরত লুত (আঃ) কে তার জাতির জন্যে সতর্ককারী নবী মনোনীত করলেন এবং আল্লাহকে ভয় করে তাদের এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে বলার নির্দেশ দিলেন। হযরত লুত (আঃ) দীর্ঘ সময় ধরে সতর্ক করার পরও যখন তাদের পরিবর্তন হল না তখন আল্লাহ তাআলা চুড়ান্ত বিপর্যয়ের মাধ্যমে সমগ্র এলাকা উল্টিয়ে দেন, আকাশ থেকে একাধারে বৃষ্টি ও পাথর বর্ষণ করে সমগ্র জাতিকে সমুলে নিশ্চিহ্ন করে দেন। বর্ণিত আছে, বর্তমান মৃত সাগর বা ডেড সি হল হযরত লুত (আঃ) এর জাতির সেই বাসস্থান যেখানে তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিলো।

সবশেষে বলা যায়, ডেড সি’র পানিতে কিছু ডুবে যায় না। এটা মানুষের কাছে একটি অতি বিস্ময়কর বিষয়। মানুষ এটা দেখে অবাক হয় আবার হয় আশ্চর্যান্বিত। তবে এই ডেড সি থেকে মানুষের শিক্ষা নেওয়ারও দরকার রয়েছে। কারণ, এখানকার অধিবাসীদের পাপাচারের কারণে ডেড সি’র সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ যদি এরকম পাপাচার অব্যাহত রাখে তবে সেই পাপাচারের কারণে আবার কোনও মৃত সাগরের যে সৃষ্টি হবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

সূত্র : উইকিপিডিয়া, তথ্য ক্যানভাস

Related posts

গুগল ফটোজে ব্যক্তিগত ছবি লুকিয়ে রাখবেন যেভাবে

News Desk

উদ্ধার বৃদ্ধের ঝুলন্ত দেহ, আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে আটক পুত্রবধূ

News Desk

বিদেশে চাকরি পাওয়ার সহজ উপায়

News Desk

Leave a Comment