২৩ জানুয়ারি ২০২০। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১১টা ৫৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। মধ্যরাত হতে বাকি মাত্র ১০০ সেকেন্ড। এবার প্রশ্ন করতে পারেন, এই ঘড়ির বিশেষত্ব কী? কেনই-বা একে নিয়ে এত মাতামাতি? উত্তর হলো, এ কোনো সাধারণ ঘড়ি নয়। ‘ডুমসডে ক্লক’ হিসেবেই এটি পরিচিত। নাম শুনে মনে হতে পারে, কোনো সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্রের খলনায়কের পৃথিবীর ধ্বংস করে দেওয়ার হাতিয়ার এটি, তবে তাও নয়। বাস্তবেই ঘড়িটির অস্তিত্ব রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে ঘড়িটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ জানান দেয়। আমরা ধ্বংসের কতটা দ্বারপ্রান্তে রয়েছি, তা নির্দেশ করে এই ঘড়ির সময়। মধ্যরাত বা ঘড়িতে ১২টা বাজাই হলো মানবসভ্যতার চূড়ান্ত ধ্বংসের নির্দেশক। বৈশ্বিক অবস্থার উন্নতি বা অবনতির ওপর নির্ভর করে ঘড়ির মিনিটের কাঁটা ১২টা থেকে দূরে সরে যেতে কিংবা অনেকটা এগিয়ে আসতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর ‘দ্য বুলেটিন অব দ্য অ্যাটোমিক সায়েন্টিস্টস’ নামে ম্যাগাজিন ১৯৪৭ সালে ঘড়িটির প্রবর্তন করে। সেসময় ঘড়ির সময় ছিল ১১টা ৫৩ মিনিট; অর্থাৎ মধ্যরাত হতে আরও ৭ মিনিট বাকি ছিল। তারপর থেকে মোট ২৫ বার ঘড়িটির সময় পরিবর্তিত হয়েছে।

অস্ত্র ও পারমাণবিক শক্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে ম্যাগাজিনটি প্রতিষ্ঠা করেন ম্যানহাটন প্রজেক্টের সাবেক বিজ্ঞানী ইউজিন রবিনউইচ ও চিকিৎসক হাইম্যান গোল্ডস্মিথ। ১৯৪৭ সালের জুনে গোল্ডস্মিথ ম্যাগাজিনটির প্রচ্ছদ এঁকে দেওয়ার অনুরোধ জানান মারটাইল ল্যাঙ্গসডর্ফকে। মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করতে প্রতীকী গণনা হিসেবে তিনি ঘড়ির ছবি এঁকে এ ধারণার প্রবর্তন করেন।

বিশ্বরাজনীতি, পারমাণবিক ঝুঁকি, জৈব সন্ত্রাস (বায়োটেরোরিজম), সাইবার নিরাপত্তা, বিজ্ঞানীদের কথা আমলে না নেওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি নানা বৈশ্বিক সমস্যার বিবেচনায় বর্তমানে ১২টার দিকে ঝুঁকে গেছে ঘড়িটির মিনিটের কাঁটা। পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে স্ট্রাটেজিক আর্মস লিমিটেশন ট্রিটি (সল্ট) স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এ ঘড়ির মিনিটের কাঁটা মধ্যরাত থেকে দূরে সরে যায়। ১০ মিনিট থেকে দূরে সরে ১২টা বাজতে ১৭ মিনিট বাকি ছিল সে সময়।
এ বছরের ২৩ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে মাত্র ১০০ সেকেন্ড দূরত্বে এসে স্থির হয় ঘড়ির কাঁটা। গত বছরের তুলনায় মধ্যরাতের দিকে আরও ২০ সেকেন্ড এগিয়েছে এ বছর। প্রতি বছর ১৩ জন নোবেল বিজয়ীসহ বুলেটিন অব অ্যাটোমিক সায়েন্সের বিজ্ঞানীরা এ সময় নির্ধারণ করেন।

ম্যাগাজিনটির প্রেসিডেন্ট র‍্যাচেল ব্রনসন জানিয়েছেন, মানুষকে ভয়াবহতার মাত্রার স্পষ্ট ধারণা দিতে বর্তমানে মিনিটের বদলে সেকেন্ডে বাকি থাকা সময় জানানো হয়। পারমাণবিক ঝুঁকি বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নেওয়া উদ্যোগের অভাব ও সাইবার অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার বিবেচনায় নেওয়া হয় এ সিদ্ধান্ত। ‘আমাদের অস্তিত্বের হুমকির বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নির্দেশক ডুমসডে ক্লক। পৃথিবীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নির্দেশক রূপক এটি। তবে সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো, এই রূপকের পেছনে আছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বৈজ্ঞানিক তথ্য ও প্রমাণাদি,’ ঘড়িটির বার্ষিক সময় উন্মোচনী সভায় এসব কথা বলেন আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ম্যারি রবিনসন।

কোভিড-১৯ মহামারি মানবসভ্যতার বিলুপ্তির মতো ভয়াবহ দুর্যোগ না হলেও, আমরা অসতর্ক হয়ে সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়িয়ে গেলে কী হতে পারে, তার কঠিন নির্দেশক। মানবমনে ভয় সৃষ্টি করতে নয়, বরং সতর্কতা প্রচারের লক্ষ্যেই এই ডুমসডে ক্লকের সৃষ্টি। বিশ্বনেতাদের এসব ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই আর। চূড়ান্ত ধ্বংসের আগে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আর ১০০ সেকেন্ডই হাতে রয়েছে আমাদের। সম্পূর্ণ ধ্বংসের থেকে মাত্র একশো সেকেন্ড দূরে দাঁড়িয়ে মানব সভ্যতা- জানাচ্ছে ডুম্সডে ক্লক। আমেরিকার ‘বুলেটিন অফ দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস’ এ বছরের জন্য এ রকমই তথ্য দিয়েছে। সেই ১৯৪৭ সাল থেকে সংস্থাটি মিনিটস টু মিডনাইটস পদ্ধতিতে গণনা করে আসছে, মানব সভ্যতা থেকে ডুম্স ডে কত দূরে। গণনা অবশ্য পুরো ম্যাথেমেটিক্যাল নয়, বরং মেটাফরিক্যাল। মানব সভ্যতার পক্ষে ক্ষতিকর ফ্যাক্টরগুলি কী অবস্থায় আছে, তার ভিত্তিতে এই গণনা।

গত বৃহস্পতিবার বুলেটিনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও প্রকাশক, রেচেল ব্রনসন এই তথ্য প্রকাশ করেন। নিজেরগ্রুপের মিলিত প্রচেষ্টার প্রতি আস্থা রেখে ব্রনসনজানাচ্ছেন, সমগ্র মানবজাতির জন্য মারাত্মক খারাপ সময় আসতে চলেছে। তবে পুরোটাই নেতিবাচক নয়। সেখানেও আশা দেখা যাচ্ছে।

ডুম্সডে ক্লক নামের এই ঘড়িটি মধ্যরাত থেকে একশো সেকেণ্ড দূরে সেট করা আছে গত বছর থেকে। এবং ঘড়ির কাঁটা দুটি কখনও, এই বছরের মতো, রাত বারোটার এতো কাছে পৌঁছোয়নি। বুলেটিন অনুযায়ী, এই ঘটনার মানে হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বিশেষ করে রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়বে এবং পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। গত এক বছর ধরে করোনাজনিত মহামারি চলাকালে আন্তর্জাতিক নেতাদের নেতিবাচক মনোভাব, সাধারণ মানুষের বিজ্ঞান এবং সরকারেরপ্রতি অবিশ্বাস, আণবিক অস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আবহাওয়ার ক্রমপরিবর্তনকে এই অবস্থার জন্য দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই সব কারণে মধ্যরাতের কাঁটা ছুঁতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ডুম্সডে ক্লক।

১৯৫৩ সালে, যখন আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম নিজেদের তাপীয়-আণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা করেছিল, সেই সময় এই ঘড়ি রাত বারোটার খুব কাছাকাছি চলে যায়। বুলেটিনের বৈজ্ঞানিক ও নিরাপত্তা সমিতি বছরে দু’বার পৃথিবীর অবস্থা নিয়ে নিজেদের প্রাপ্ত তথ্য আদান-প্রদানের জন্য একত্রিত হন। যদি ডুম্সডে ক্লক মধ্যরাতের ঘর ছুঁয়ে ফেলে তবে তার ফলাফলকী হতে পারে এবং তারপরের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েও সেখানে আলোচনা করা হয়। ডুম্সডে ক্লকে যে সময় দেখা যায়, তা পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্ণয় করা হয় নাকি তা বৌদ্ধিক তত্ত্বের দ্বারা, আগামি ধ্বংসের ইঙ্গিত বহন করে আনে– তা-ও তাঁরা ভাবনা-চিন্তার মধ্যে রাখেন।

পরমাণু-বিশেষজ্ঞ, আবহাওয়াবিদ এবং বিজ্ঞানের নানা শাখার পণ্ডিতরা এই সমিতির সদস্য। তবে তাঁরাও ডুম্সডে ক্লকের কার্য- পদ্ধতি নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত নন। এত দিন, এই সমিতি দুনিয়ায় ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিবাচক কথা বলে এসেছেন। ১৯৯০ সালের কোল্ড ওয়ার শেষ হতে, দেখা যায়, ঘড়িটিতে রাত বারোটা বাজতে বারো মিনিট বাকি। পরের বছর এই সময়বেড়ে হয় সতেরো মিনিট। ২০২১ সাল নিয়ে চিন্তিত হলেও, সমিতি এখন ভরসা রাখছেনব-নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শুভবুদ্ধির ওপর। সম্প্রতি জো বাইডেন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুই দেশের আণবিক চুক্তিকে সম্প্রসারিত করেছেন।

বুলেটিনের অন্যতম সদস্য, এমআইটি-এর পরিবেশবিদ্যার অধ্যাপক সুজান সলোমন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমেরিকার নব্য প্রেসিডেন্টের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই ব্যাপারে তাঁর কার্যকরী পদক্ষেপ ও সাহায্য, পৃথিবীকে নতুন দিশা দেখাবে।’ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাক্তন গর্ভনর জেরি ব্রাউন এই বুলেটিনের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, ‘আণবিক অস্ত্রই যে মানব-সভ্যতার প্রধান শত্রু আমজনতাকে তা বোঝাতে ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতারা।’ তাঁর মতে, মানবজাতিকে রক্ষা করতে হলে এখনই আণবিক অস্ত্র নির্মাণ বন্ধ করতে হবে এবং সঞ্চিত আণবিক অস্ত্রসমূহকে দ্রুত নষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, আর মাত্র ১০০ সেকেন্ড বাকি রাত বারোটা বাজতে।

এ সবের পরেও মানুষকে আতঙ্কিত হতে বারণ করছেন ম্যাকালেস্টার কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু ল্যাথাম। কারণ, ডুম্সডে ক্লক নামের এই ঘড়িটি সেট করা, অঙ্ক ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নয়। এর ভিত্তি বুদ্ধিমত্তা, আশঙ্কা এবং বিশেষজ্ঞদের থেকে পাওয়া তথ্য ও পারস্পারিক আলোচনা। ল্যাথামের কথায়, ‘এই ঘড়ি আসলে সাবধানতার সূচক। যুদ্ধের আগমন বার্তা নয়। সেই কারণে, একে একেবারেই অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। বছরে একবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আসন্ন বিপদের কথা জানিয়ে দেয় ডুম্সডে ঘড়ি এবং মনে করিয়ে দেয় মানুষের তৈরি বিপদ থেকে মানুষই নিজেকে রক্ষা করতে পারে।’

Related posts

পৃথিবীর সব থেকে সুরক্ষিত ৮ টি বাড়ি

News Desk

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ১০টি ফুল

News Desk

নিজের মুখটাকে খুঁজছে মানুষ

News Desk

Leave a Comment