জোড়া শালিক দেখা নিয়ে অনেকের মনেই অনেক ধারনা আছে। ছোটবেলা ছেলেমেয়েরা ক্লাসের জানালা দিয়ে জোড়া শালিক দেখলে মনে করতো আজ বোধহয় ক্লাসের স্যারের হাতে মার খাওয়া থেকে বেঁচে যাবে। আবার অনেকে পরীক্ষার দিতে যাওয়ার সময় জোড়া শালিক দেখা শুভ মনে করত। বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হলে নিজের রুমের পেছনের বারান্দায় বসে সিগারেট টানছিলো শুভ। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করার আগে নিজের রুমের পেছনের বারান্দায় বসে একটা সিগারেট না টানলে নাকি ওর বাথরুম ক্লিয়ার হয় না। হলে ওর রুমমেটরা সবাই অনেক দেরি করে ঘুমায় আর উঠেও অনেক দেরিতে। কিন্তু শুভ সাধারনত ওঠে অনেক সকালে। সকালের মৃদ্যু মন্দ বাতাস, চারিদিকের নির্মল প্রকৃতি তার কাছে খুব ভালো লাগে।
সিগারেট টানা শেষ করে চেয়ার থেকে উঠতে যাবে এমন সময় সে বারান্দার সিলিঙ্গে লক্ষ করলো শুধুমাত্র একটি শালিক এসে এখানে বাসা বেঁধেছে। সাধারনত একটা শালিক কখনোই বাসা বাঁধে না, দুইটা থাকে। ও ভাবলো, এইটা মনে হয় মেয়ে শালিক ঘরদোর গোছানোর কাজে ব্যস্ত, পুরুষ শালিকটি হয়ত খাবার সংগ্রহের কাজে বের হয়েছে। তারপর সে তার অন্যান্য রুমমেটদেরও বলে দিলো যেন তারা এই বাসাটি না ভাঙে। শুভ এই রুমের সবচেয়ে সিনিয়র।
পরেরদিন সকালে শুভ আবার চেয়ারটাতে বসে আছে।শালিকের বাসার দিকে চেয়ে আছে। আজকেও সে একটা শালিকই দেখতে পেলো। একটা শালিক দেখে দিন শুরু করলে নাকি দিনটা খারাপ যায়, এমন কুসংস্কারে বিশ্বাস নেই শুভর। তারপরেও গতকাল একটা শালিক দেখে দিন শুরু করায় তার দিনটা ভালো যায়নি। তার প্রেমিকা প্রিয়ার সাথে গতকাল বিশাল এক ঝগড়া হয়েছে। এর পর থেকে মনটা ভালো নেই শুভর। রাতে ঘুমটাও ভালো হয়নি। প্রিয়ার সাথে শুভর সম্পর্ক সেই সেকেন্ড ইয়ার থেকে,একই সাথে পড়াশুনা করেছে ওরা। অনেকদিন ধরেই প্রিয়ার বিয়ের কথাবার্তা চলছে, কিন্তু প্রিয়া শুভর জন্য অন্যান্য বিয়ের প্রপোজালগুলো ফিরিয়ে দিয়েছে।
এদিকে শুভ সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছে, এখনো কোন চাকুরি যোগার করতে পারেনি। পারিবারিক অবস্থাও খুব একটা ভালো না যে বাবার টাকায় বউ পালবে। নিজের খরচ চালাতেই সে হিমসিম খায়, একটা টিউশনি করে আর ভর্তি সিজনে কোচিং ক্লাস নিয়ে তার নিজের খরচ যোগার করে। সে মাঝে মাঝে ভাবে, সমবয়সী একটা মেয়ের সাথে তার প্রেম করা উচিৎ হয়নি, কারন মেয়েদের বিয়ের জন্য একটা হৃষ্টপুষ্ট শরীরই যথেষ্ঠ কিন্তু ছেলেদের বিয়ের জন্য দরকার ক্যারিয়ার অমুক তমুক হাবিজাবি, যতদিনে একটা ছেলে বিয়ের উপযুক্ত হয়, ততদিনে অনেক মেয়ের কয়েকটা ছেলে মেয়ে জন্ম দেবার সময় পার হয়ে যায়। আজ আবার একটা শালিক দেখে তার মন খারাপ হয়ে গেলো, আজকের দিনটাও তার খারাপ যাবে মনে হয়।
প্রতিদিন সকালে উঠে যেন একটা শালিক না দেখতে হয় এই জন্য শুভ কাঁটাবন থেকে একটা খাঁচা আর একটা শালিক কিনে নিয়ে আসলো। কাঁটাবনের দোকানগুলোতে সাধারনত শালিক বিক্রি করে না। শালিক পাখিটির শরীরের সাদাকালো রঙ আর কথা বলতে পারার অক্ষমতার কারনেই কেউ কখনো শালিক কেনে না। তাই দোকানীরা রাখেও না। শুভ অর্ডার দিয়ে শালিক আনাতে হয়েছে, তাই খরচটাও একটু বেশী পরেছে। খাঁচাটিকে সে পাখির বাসাটির খুব কাছেই ঝুলিয়ে রাখলো। এখন থেকে সকালে উঠে আর একটা শালিক দেখতে হবে না তার, তার দিনগুলো ভালো যাবে এই ভেবে সে মনে মনে কিছুটা প্রশান্তি অনুভব করলো।
এরপর থেকে কিছুদিন শুভর দিনগুলা ভালোই কাটলো। দুইটা চাকুরীর জন্য ভাইভা দিয়েছে, যদিও কোনটাতেই এখনো ডাকেনি। একটা ভালো বেতনের টিউশনিও পেয়েছে। প্রিয়ার সাথে ঝামেলাটাও মিটেছে। সময়টা ভালোই কাটছে ওর। প্রতিদিন সকালে উঠে সে এখন দুইটা শালিক দেখে, একটা খাঁচার ভেতরে আরেকটা পাখির বাসায়। খাঁচার শালিকটা দেখে শুভর খুব খারাপ লাগে যে আরেকটা পাখি তার সামনে দিয়েই সবসময় উড়ে উড়ে বেড়ায় অথচ সে খাঁচায় বন্দি থাকে সবসময়। পাখা থেকেও সে উড়তে পারে না। খাঁচার শালিকটিকে শুভ নিয়মিত খাবার দেয়, অথচ অন্যটি স্বাধীনভাবে নিজের খাবার নিজেই যোগার করে। সে মাঝে মাঝে ভাবে, খাচার পাখিটিকে ছেড়ে দেবে কিনা, কিন্তু খাঁচা থেকে ছেড়ে দিলে পাখিটি এখানে থাকবে সেটার নিশ্চয়তা কি? আবার সে ইচ্ছে করলেই বাসার পাখিটিকে খাঁচায় ভরতে পারবে না। পাখিদুটোর এই দুইরকম অবস্থা নিয়ে শুভর চিন্তার শেষ নেই।
একটা চাকুরীর ভাইভা দেবার জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলো শুভ। ওখানে ওর ফুফুর বাসায় গিয়ে উঠেছিলো, অনেক দিন পর ফুফুর বাসায় যাওয়ায় ফুফু কয়েকদিন না থেকে আসতে দেয়নি। পতেঙ্গা সি বিচে ঘুরতে গিয়ে নিজের মোবাইলটা পানিতে ফেলেছে শুভ। তারপর থেকে সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ। ঢাকায় ফেরার পর প্রথমেই সে এলো তার বারান্দায়, বারান্দায় এসে দেখে খাচার ভেতরের পাখিটি মরে পরে আছে। গত কয়েকদিনে সে বাইরে থাকায় তাকে খাবার দেয়া হয়নি, না খেতে পেয়ে পাখিটি মরে গেছে। কিছুক্ষনের মাঝে বাসার পাখিটি বাসায় ফিরলো। আবারো তাকে দেখতে হলো একটা শালিক। শুভর রুমমেট ওর হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই চিঠিটা গতকাল এসেছে। চিঠিটা খুলে শুভর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, চট্টগ্রামে যে ভাইভাটা দিয়েছিলো সেই চাকুরিটি ওর হয়ে গেছে। সে তখন ভাবলো, শালিক একটা হোক আর দুইটা হোক এইটা কোন ব্যাপার না, আসলে সবকিছু নিজের মধ্যে, ভাগ্য বলে কিছু নেই। চাকুরীর খবরটা প্রিয়াকে না জানালেই নয়। রুমমেটের ফোন থেকে প্রিয়াকে ফোন করলো শাহেদ। ফোন ধরলো তৃনার মা, ধরে বলল, তৃনার আজ বিয়ে, ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট। শুভ বারান্দায় বসে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে একটি মৃত আরেকটি জীবিত শালিকের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো।
আর ভাবল, আসলেই কি জোড়া শালিক দেখায় কিছু হয়?? নাকি অন্যকিছু। তারপর শুভর দিনকাল দীর্ঘদিন খারাপ কাটল। একদিন আবারো সে পতেঙ্গাতে ঘুরতে গিয়ে একজোড়া শালিক কিনে আনল। সেদিন থেকেই তার দিনগুলা আবার অন্যরকম হতে থাকল। সেদিনই সে জানতে পারলো সে প্রিয়ার বিয়ের যে খবর শুনেছিল সেই বিয়েটি আর হয়নি। প্রিয়া আবার শুভর কাছে ফিরে আসতে চায়। তার রঙ্গিন দিনগুলো আবারো রাঙ্গিয়ে দিলো তার সেই জোড়া শালিক।