Image default
জানা অজানা

অ্যান্টার্কটিকা, থেকে হয়ে গেল বিবেকানন্দ রক!

জিওলজিস্টরা বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালকে দ্য গন্ডোয়ানা জাংশন বলেন, কারণ এটা সেই জায়গার চিহ্ন যেখানে এক সময় ভারত, মাদাগাসকর, শ্রীলঙ্কা, পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা আর অস্ট্রেলিয়া একসঙ্গে জুড়ে ছিল। তার মানে, ভেঙেচুরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত, উত্তরপূর্ব ভারতের শিলং থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ছিল অস্ট্রেলিয়ার পার্‌থ!

এখানে পানির তিনটি রং। কারণ, তিনটি সাগর এসে মিশেছে হেথায়— আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগর। কোন সাগরের কী রং? তা স্পষ্ট করে বলতে পারব না। কিন্তু, ভারতের দক্ষিণতম এই প্রান্তের সৌন্দর্যের টানে যুগে যুগেই পর্যটকরা ভিড় জমিয়েছেন এখানে। এখানেই নাকি সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন বিবেকানন্দ। হ্যাঁ, ভারত মহাসাগরে সেই বিখ্যাত বিবেকানন্দ মেমোরিয়ালের কথা বলছি। যে বিশাল পাথরের উপর তৈরি এই মেমোরিয়াল, তার নাম বিবেকানন্দ রক। এই পাথর নিয়েই বলব আজ এক সাংঘাতিক গল্প! জানেন কি, এই কথা-না-বলা পাথরেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীটা ভেঙেচুরে যাওয়ার গল্প। এই রকটাই তো সেই জিওলজিক্যাল ওয়ান্ডার! ১৬ কোটি বছর আগে এখান থেকে ভাগ হয়ে গিয়েছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর অ্যান্টার্কটিকা!

অ্যান্টার্কটিকা, থেকে হয়ে গেল বিবেকানন্দ রক!
ছবি: thebetterindia.com

আজ এটা ভাবতে অবাক লাগে, একটা সময় ভারত, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, মাদাগাসকর, অস্ট্রেলিয়া আর অ্যান্টার্কটিকা মিলিয়ে ছিল একটাই সুপারকন্টিনেন্ট। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন অঞ্চল গন্ডোয়ানার নাম অনুসারে ভূতত্ত্ববিদ এডুয়ার্ড সুয়েস এর নাম রাখেন গন্ডোয়ানাল্যান্ড। প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে প্রিক্যামব্রিয়ান যুগের শেষ দিকে গন্ডোয়ানা সুপারকন্টিনেন্ট পুরোপুরি তৈরি হয়। আর কয়েক কোটি বছর ধরে তৈরি হওয়া এই বিশাল ভূখণ্ডের ভাঙাচোরার ঘটনাটাও একদিনে ঘটেনি, তা হয়েছে ধাপে ধাপে।

তখনও প্রথম হোমিনিডসরা পৃথিবীতে আসেনি, তারও অনেক আগে জুরাসিক যুগের গোড়ার দিক, এখন থেকে প্রায় ১৮ কোটি বছর আগের কথা! শুরু হল গন্ডোয়ানা ভাঙার প্রথম পর্ব। পশ্চিম অংশ অর্থাৎ আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পূর্ব অংশ অর্থাৎ মাদাগাসকর, ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর অ্যান্টার্কটিকা থেকে। জন্ম হল আটলান্টিক মহাসাগর আর ভারত মহাসাগরের। প্রায় ১৪ কোটি বছর আগে।

কী করে?

আফ্রিকা থেকে আমেরিকা ভেঙে বেরিয়ে এলে পর তৈরি হল দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর। আর ঠিক ওই সময়েই ভারত আর মাদাগাসকর একসঙ্গে জুড়ে থাকলেও ভারত আলাদা হয়ে গেল অ্যান্টার্কটিকা আর অস্ট্রেলিয়ার থেকে। ফলে, তৈরি হল ভারত মহাসাগরের মধ্যভাগ।

ক্রিটেসিয়াস যুগের শেষ ভাগ, ১১ কোটি ৮০ লক্ষ বছর আগের কথা। একটা বিশাল জিগস অফ পাজলের অংশগুলোর মতোই একে অপরের থেকে আলাদা হতে লাগল কন্টিনেন্টের আর সব অংশগুলো। মাদাগাসকরের থেকে বেরিয়ে গেল ভারত আর অস্ট্রেলিয়াও অ্যান্টার্কটিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধীরে ধীরে সরে আসতে লাগল। এ ভাবেই একে অপরের থেকে ভেঙেচুরে বেরিয়ে এসে, ভেসে ভেসে আবার জুড়ে তৈরি হল আজকের পৃথিবীর এই মানচিত্র।

প্রায় ১২ কোটি বছর আগে ভারতের ভূখণ্ড ভেঙে আস্তে আস্তে উত্তর দিকে সরতে আরম্ভ করে। এটা খুবই ধীরে হচ্ছিল। কিন্তু ৮০ কোটি বছর আগে এর গতি আমচমকাই গেল বেড়ে। প্রতি বছর ১৫ সেন্টিমিটার করে উত্তর দিকে চলতে শুরু করল ভারত। ফলে? ধাক্কা লাগল ইউরেশিয়ার সঙ্গে, প্রায় ৫০ কোটি বছর আগেকার কথা। আর এই ধাক্কাধাক্কির পরিণতি? আজকের হিমালয় পর্বত তৈরির সূচনা!

অ্যান্টার্কটিকা, থেকে হয়ে গেল বিবেকানন্দ রক!
ছবি: eisamay.indiatimes.com

বায়োকেমিস্ট এবং লেখক প্রণয় লাল তাঁর বই ‘ইন্ডিকা’-তে এই প্রক্রিয়াটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেছেন। লিখেছেন, ‘জিওলজিস্টরা বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালকে দ্য গন্ডোয়ানা জাংশন বলেন, কারণ এটা সেই জায়গার চিহ্ন যেখানে এক সময় ভারত, মাদাগাসকর, শ্রীলঙ্কা, পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা আর অস্ট্রেলিয়া একসঙ্গে জুড়ে ছিল।’ আশ্চর্য ভেঙেচুরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত, উত্তরপূর্ব ভারতের শিলং থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ছিল অস্ট্রেলিয়ার পার্থ!

যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা কন্টিনেন্টগুলোর এই ভাঙাচোরা, তার পর সমুদ্রে ভেসে আবার নতুন করে তৈরি হওয়ার ইতিহাসে ভারত তৈরি হওয়ার গল্পটাও জাস্ট দারুণ। আর কতই না রোমাঞ্চকর ছিল সেই যাত্রাপথ, কোটি কোটি বছর ধরে যা পেরিয়ে এসে আজকের ধন-ধান্যে-পুষ্পে ভরা শস্য শ্যামলা ভারত হয়েছে! চারনোকাইট রকের একটা বিশাল অংশ বিবেকানন্দ রক, যা কি না আজও একটা তিমির পিঠের অংশের মতোই ভারত মহাসাগরে উঁচু হয়ে জেগে রয়েছে। একমাত্র সাক্ষী এই পাথর হয়তো অপেক্ষায় থাকে পৃথিবী তৈরির এই গল্পটা আমাদের জানানোর জন্যই!

Related posts

আমরা হাই তুলি কেন?

News Desk

সিকাডা ৩৩০১ : ইন্টারনেট জগতের অমীমাংসিত রহস্য

News Desk

চীনের রহস্যময় পাথরের জঙ্গল

News Desk

Leave a Comment