Image default
স্বাস্থ্য

ডেঙ্গু জ্বর: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধে করণীয়।

মশা বাহিত একপ্রকার ভাইরাস জ্বর ডেঙ্গু। এই জ্বর অন্যান্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত জ্বর থেকে আলাদা। করোনা মহামারীর এই সময়ে আবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডেঙ্গু বর্তমান সময়ের সবচেয়ে পীড়াদায়ক রোগের একটি। এই জ্বরে আক্রান্ত একদিকে যেমন দূর্বল হয়ে পড়ে অন্যদিকে এর রেশ শরীরে থেকে যায় দীর্ঘদিন। ডেঙ্গু জ্বর হয়ত বা নির্মূল করা যাবে না। যেহেতু এর কোন ভ্যাক্সিনও বের হয় নাই, কোন কার্যকরী ঔষধও আবিস্কৃত হয় নাই। তবে ডেঙ্গু প্রাণঘাতি কোনো রোগ নয়। বিশ্রাম ও নিয়মমাফিক চললে এ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়টাতেই ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে এই জ্বর হয় না বললেই চলে। শীতে লার্ভা অবস্থায় ডেঙ্গু মশা অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষার শুরুতেই সেগুলো থেকে নতুন করে ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত মশা বিস্তার লাভ করে।

ডেঙ্গু জ্বরের কারণঃ

ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা এবং এই ভাইরাস বাহিত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশাটিও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।

সাধারণত শহর অঞ্চলে অভিজাত এলাকায়, বড় বড় দালান কোঠায় এই মশার প্রাদুর্ভাব বেশি, তাই ডেঙ্গু জ্বরও এই এলাকার বাসিন্দাদের বেশি হয়। বস্তিতে বা গ্রামে বসবাসরত লোকজনের ডেঙ্গু কম হয় বা একেবারেই হয় না বললেই চলে।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদঃ

ডেঙ্গু ভাইরাস ৪ ধরনের হয়ে থাকে। তাই ডেঙ্গু জ্বরও ৪ বার হতে পারে। যারা আগেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু হলে তা মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহঃ

ডেঙ্গুজ্বরকে ‘ব্রেক-বোন ফিভার’ নামে ডাকা হয়। কারণ এটি কখনও কখনও গুরুতর হাড় এবং পেশির ব্যথার কারণ হতে পারে। এই জ্বর আসলে কোনো হাড় ভাঙে না। তবে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়।

সাধারণত কেউ আক্রান্ত হওয়ার চতুর্থ থেকে ১৪তম দিন পরে লক্ষণ দেখা দেয়। ভাইরাসে সংক্রামিত কিছু লোকের আবার কোনো লক্ষণ দেখা দেয় না। ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে, ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর এবং ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর।

সাধারণ ভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে। আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে।
♦ চক্ষুকোঠর, বিভিন্ন হাড়ের জোড়, পেশি এবং হাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা।
♦ ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ।
♦ নাক বা মাড়ি থেকে রক্ত ক্ষরণ

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু হেমোরজিক ফিভার নামে একটি মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাদের ডেঙ্গুজ্বরের নিয়মিত লক্ষণগুলো দ্বিতীয় থেকে ৭ম দিনের মধ্যে থাকবে। জ্বর কমে যাওয়ার পরেও তাই এই লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
♦ বমিবমিভাব এবং বমি।
♦ পেটে প্রচণ্ড ব্যথা।
♦ শ্বাস নিতে সমস্যা।
♦ প্রচুর রক্তক্ষরণ।
যদি ডেঙ্গু হেমোরজিক জ্বরের সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসা না করা হয় তবে একজন ব্যক্তির প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং মারা যেতেও পারে। এই রোগের বেলায় অনেক সময় বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনীতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরজিক জ্বরযুক্ত ব্যক্তিদের অবিলম্বে একটি চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ডেঙ্গু শক সিনড্রোমঃ

ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ হল ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সাথে সার্কুলেটরী ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হল-

♦ রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া।
♦ নাড়ীর স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়।
♦ শরীরের হাত পা ও অন্যান্য অংশ ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
♦ প্রস্রাব কমে যায়।
♦ হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে করণীয়ঃ

১. শহর এলাকায় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে কোনো রোগীর ক্ষেত্রে জ্বরসহ উপরোল্লিখিত উপসর্গ দেখা দিলে প্রথমেই নিকটস্থ ডাক্তারে শরণাপন্ন হওয়া
২. জ্বর উপশমের ওষুধ নিয়মিত সেবনের পাশাপাশি অধিক মাত্রায় তরল পানীয় (খাবার স্যালাইন, ফলের রস, ডাবের পানি ও স্যুপ) পান করতে হবে।
৩. জ্বর অবস্থায় ও জ্বর সেরে যাওয়ার পরেও প্রায় ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
৪. জ্বর অবস্থায় ডেঙ্গু নিশ্চিত হলে কোনো অবস্থায় এসপিরিন বা ডিসপিরিন জাতীয় ওষুধ সেবন করা যাবে না।
৫. জ্বর অবস্থায় প্যারাসিটামলের পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে।
৬. ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর রক্তের অনুচক্রিকার পরিমান যখন ১০০০০ এর নিচে আসবে তখনই কেবলে উক্ত রোগীর শরীরে অনুচক্রিকা সঞ্চালন করতে হবে।
৭. ছাগলের দুধ প্রচুর পরিমাণে সেলিনিয়াম থাকায় ইহা ডেঙ্গু জ্বরের রোগীর প্লাটিলেট দ্রুত স্বাভাবিক মাত্রায় আনতে সাহায্য করে।

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে করণীয়ঃ

১. ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই হল এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, এডিস মশা স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সাথে মশক নিধনের জন্য প্রযোজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

২. বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে, তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত জিনিস যেমন মুখ খোলা পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি যেন না থাকে। একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে।

৪. এডিস মশা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে বের হতে হবে, প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরের চারদিকে দরজা জানালায় নেট লাগাতে হবে।

৫. দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে।

৬. ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে করে রোগীকে কোন মশা কামড়াতে না পারে। মশক নিধনের জন্য স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সাথে সাথে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারী ব্যবহার করতে হবে।

Related posts

Ohio woman who lost all four limbs to flu complications speaks out to raise awareness

News Desk

কানের মোম প্রথম পার্কিনসন রোগের ক্লু সরবরাহ করতে পারে, অধ্যয়নের পরামর্শ দেয়

News Desk

জরায়ু ক্যান্সারের মৃত্যু শীঘ্রই ওভারিয়ান ক্যান্সার থেকে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পারে, অনকোলজিস্ট বলেছেন: ‘আমাদের আরও ভাল করতে হবে’

News Desk

Leave a Comment