Image default
আন্তর্জাতিক

শম্ভু-জাহাঙ্গীরে ব্র্যাকেট বন্দি বরগুনা আওয়ামী লীগ

পাঁচবারের সংসদ-সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এবং দ্বিতীয় দফায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নিয়ন্ত্রণ করছেন বরগুনা আওয়ামী লীগ। ৩৫ বছর ধরে নেতৃত্বে থাকা এ দুই নেতা কেবল মূল দল নয়, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব সংগঠনের নেতৃত্ব রয়েছে তাদের আত্মীয়-স্বজন ও আস্থাভাজনদের হাতে।

মাঝে একবার কেন্দ্র থেকে ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়ায় এখানে লংকাকাণ্ড বেঁধে যায়। শম্ভু-জাহাঙ্গীরের আশকারায় ছাত্রলীগের নয়া কমিটির ওপর তাদের অনুসারীদের হামলার অভিযোগ ওঠে। আর হামলাকারীদের লাঠিচার্জ করায় বরগুনা থেকে তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়।

এদিকে বরগুনা-১ আসনে (সদর-আমতলী-তালতলী) আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি বেশ দুর্বল। ৪৪ বছরেও এখান থেকে বিএনপির কেউ এমপি হতে পারেননি। বর্তমানে তৃণমূলের কমিটি গঠন নিয়ে ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। দল পরিচালনায় কেন্দ্রীয় নেতা ফিরোজ উজ জামান মামুন ওরফে বিমান মামুনের হস্তক্ষেপে এখানে বিএনপি শক্তিশালী হচ্ছে না বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন।

হুকুম বহালের সম্মেলন : ১৬ নভেম্বর বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ঢাকঢোল পিটিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। কমিটি গঠনে যথারীতি কেন্দ্রীয় নেতারা সাবেক হুকুম বহাল করেন। পুরোনো কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এবং সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবিরের নাম নতুন করে ঘোষণা করা হয়। অবশ্য সামান্য একটু নতুনত্ব ছিল। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে গোলাম সরোয়ার টুকুর নাম ঘোষণা করা হয়।

২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন টুকু। এ কারণে তার (টুকু) নাম প্রস্তাব ও সমর্থনকারীকে হামলা ও মারধরের শিকার হতে হয়।

জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ১৯৮৭ সালে শম্ভু প্রথম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর থেকে তিনিই দলের হর্তা-কর্তা। ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীর কবির সাধারণ সম্পাদক হলে পদোন্নতি পেয়ে শম্ভু সভাপতি হন। তাদের পছন্দের লোকজন পদ-পদবি পান আর বিরোধীপক্ষের লোকেরা কোণঠাসা হন। প্রায় তিন যুগ ধরে এভাবেই চলছে। এখানে আওয়ামী লীগ এখন শম্ভু-জাহাঙ্গীর লীগে পরিণত হয়েছে।

অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনেও পরিবারতন্ত্র : কেবল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নয়, কেউ যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে সেজন্য আত্মীয়-স্বজন আর আস্থাভাজনদের দিয়ে শম্ভু-জাহাঙ্গীর দল চালান। সর্বশেষ সম্মেলনের আগে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন এমপি শম্ভুর ছেলে অ্যাডভোকেট সুনাম দেবনাথ। তরুণ লীগের সভাপতিও সুনাম। এ ছাড়া শম্ভুর স্ত্রী মাধবী দেবনাথ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। সুনামের স্ত্রী কাসফিয়া দেবনাথ আছেন মহিলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদিকা পদে। শম্ভুর বেয়াই নন্দ তালুকদার ছিলেন সদ্য সাবেক জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ। একই কমিটির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন নন্দের ছোট ভাই সুবল তালুকদার। শম্ভুর ভাগ্নি ও বড় বোনও আছেন পৌর আওয়ামী লীগ এবং জেলা মহিলা লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে।

এমপি শম্ভুর মতোই দলের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন জাহাঙ্গীরের পরিবার। তার স্ত্রী ইয়াসমিন কবির মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। ছেলে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জুবায়ের আদনান অনীক বর্তমানে যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সদ্য সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক ছিলেন আরেক ছেলে আদনান রুবেল। ছোটভাই হুমায়ুন কবির ছিলেন সিনিয়র সহসভাপতি। বড়ভাই আলমগীর কবির পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। ভাগ্নে শিপন জমাদ্দার জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক। আরেক ভাগ্নে টিটু পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়েও নানা নেতৃস্থানীয় পদে আছেন তার আত্মীয়স্বজন।

ক্ষুব্ধ স্থানীয় নেতারা : সর্বশেষ সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন গোলাম সরোয়ার টুকু। বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে আওয়ামী লীগ এখন বোবা দল। জাতীয় দিবসভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালনে দলের কার্যক্রম আটকে আছে। বর্তমান সরকারের নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রচার অথবা এ সরকারের সাফল্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এখানকার নেতৃত্ব। দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের বয়স ৫০-৫২ বছরের নিচে। অথচ এখানে যারা দলের নেতৃত্বে আছেন তারা ৮০’র কোঠায়। এ কারণে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, দলে ভয়াবহ পরিবারতন্ত্র চলছে। দল চালানোর দায়িত্বে থাকা নেতারা নিজেদের বাইরে কাউকে বিশ্বাস করেন না।

সদ্য সাবেক জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মোতালেব মৃধা বলেন, সম্মেলন হয়েছে, বহালও হয়েছে সাবেক হুকুম। এখন তো আর কিছু বলে লাভ নেই। তবে সবাই পরিবর্তন চেয়েছিল। নতুন নেতৃত্ব আর পরিবারতন্ত্রের কবল থেকে দল মুক্ত হোক এটাই কামনা সবার।

যা বলেন শম্ভু-জাহাঙ্গীর : প্রায় একই সুরে সব অভিযোগের জবাব দিয়েছেন এমপি শম্ভু ও জেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর। অভিযোগকারীদের নাম উল্লেখ করে তারা বলেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন। তাদের পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগ করেননি। বাপ-দাদার খোঁজ নিলেই দেখা যাবে সবাই ছিল বিএনপি-জামায়াত। আওয়ামী লীগ করতে গিয়ে জেল খেটেছি, রক্ত দিয়েছি। হুট করে কেউ এসে নেতৃত্ব চাইলেই হলো?’

পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ প্রসঙ্গে তারা বলেন, পুরো বরগুনায় আওয়ামী লীগ বলতে তো আমরাই। ছেলে-বিয়ে করিয়েছি আওয়ামী লীগ নেতার মেয়ের সঙ্গে, মেয়ে বিয়ে দিয়েছি আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের সঙ্গে। এখন আত্মীয় হয়েছেন বলে কি তারা রাজনীতি ছেড়ে দেবেন? যোগ্যতা থাকলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা দলে পদ-পদবি পাবে এটাই স্বাভাবিক। এমপি-নেতার পরবর্তী প্রজন্ম রাজনীতি করতে পারবে না-এটা কোন বিধানে আছে? যারা এসব বলেন তাদের পরিবার কখনোই নৌকায় ভোট দেয়নি। তারা আসলে আওয়ামী লীগের বারোটা বাজাতে চায়।

চরম অস্থিরতা বিএনপিতে : বরগুনার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে আলাদা আসন হিসাবে আমতলীতে এমপি হয়েছিলেন মতিউর রহমান তালুকদার। সেই হিসাবটুকু বাদ দিলে ৪৪ বছরে সদরে কখনো জয়ের মুখ দেখেনি বিএনপি। দল পুনর্গঠনের অংশ হিসাবে নতুন জেলা কমিটির আহবায়ক করা হয়েছে মাহবুবুল আলম ফারুক মোল্লাকে এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা তরিকুল ইসলাম মিঠুকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।

এরই মধ্যে তারা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছেন। এসব কমিটি গঠনে ঘুসবাণিজ্য করার অভিযোগও উঠেছে। কমিটিগুলোয় আওয়ামী লীগের লোকজনকে রাখার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া দলীয় কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় সহ-শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ফিরোজ উজ জামান মামুনের বিরুদ্ধে। একসময় বিমানে চাকরি করতেন বলে তাকে সবাই বিমান মামুন নামে চেনেন। বরগুনার ছেলে মামুন এক সময় ছাত্রলীগ করতেন।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও দুবারের ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বলেন, কলেজ জীবনে সরাসরি ছাত্রলীগের মিছিল সমাবেশ করতে দেখেছি মামুনকে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ছবি পর্যন্ত রয়েছে। এখন দেখছি কেন্দ্রে বসে তিনিই বরগুনা বিএনপি নিয়ন্ত্রণ করছেন। জেলার আহ্বায়ক কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সবকিছুই চলছে তার ইশারায়। যেখানেই কমিটি হচ্ছে সেখানেই ত্যাগী পরীক্ষিতদের বাদ দিয়ে নিজের লোকজন ঢোকাচ্ছেন তিনি। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের লোকজন পর্যন্ত কমিটিতে স্থান পাচ্ছে। অভিযোগ করে মাহফুজুর বলেন, আমার তো মনে হয় আওয়ামী লীগের এজেন্ট হিসাবে তিনি বিএনপিকে ধ্বংস করছেন।

আতমলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জালাল ফকির বলেন, নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন করছেন না জেলার নেতারা। বিমান মামুনের ইশারায় আবার এ জেলা কমিটি আবার গঠিত হয়েছে। সবাই মিলে দলে একটা জগাখিচুরি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন। তালতলী-আমতলীসহ বিভিন্ন উপজেলার কমিটিতে আওয়ামী লীগের লোকজনকে রাখা হচ্ছে।

অভিযোগ সম্পর্কে ফিরোজ উজ জামান মামুন বলেন, একজন সহ-সম্পাদকের পক্ষে একটি জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কিনা- সেই প্রশ্ন করছি আমি। জেলার হেভিওয়েট নেতারা দল চালাচ্ছেন। তারা আমার কথা কেন শুনবেন? এক সময় ছাত্রলীগ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্য দল থেকে এসে বিএনপির রাজনীতি করা যাবে না-এমন কোনো বিধান কি আছে? আনুগত্য প্রমাণ করেছি বলেই দল আমাকে পদ দিয়েছে। নিজ এলাকায় আমার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। এসব অভিযোগের কোনোটাই সত্য নয়।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাহবুব আলম ফারুক মোল্লা বলেন, মামুন এখানে সংসদ নির্বাচন করতে চান। সেভাবেই তিনি নিজেকে তৈরি করছেন। দলীয় কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ বলতে যা বোঝায়-তেমন কিছুই তিনি করেননি। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বিএনপি এখানে অনেক বেশি শক্তিশালী। দল অথবা সংগঠনে কোনো সমস্যা যেমন নেই। তেমনি পদবাণিজ্যের অভিযোগও সত্য নয়। পদবঞ্চিতরা এসব মিথ্যা অভিযোগ করছেন।

Related posts

প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাপ্পির গানে একাত্ম বোধ করবে, মোদির টুইট

News Desk

২০০ কোটি ডোজের ৬০ শতাংশই পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত

News Desk

মেক্সিকোর কারাগারে হামলা, নিহত ১৪

News Desk

Leave a Comment