কৌশলী ভ্লাদিমির পুতিন। বুঝে শুনে যেন দাবার ঘুঁটি চাললেন। তিনি সরাসরি যুদ্ধ শুরু করলেন না। কিন্তু রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদী নিয়ন্ত্রিত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিলেন। এখানেই থেমে থাকেননি। সঙ্গে সঙ্গে ওই দুটি অঞ্চলে ‘শান্তিরক্ষী’ হিসেবে নিজের দেশের সেনাদের নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে যুদ্ধ নয়, তিনি দুটি প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদেরকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। এর অর্থ তিনি ইউক্রেনের ওই দুটি অঞ্চলে সামরিক আগ্রাসন বা হামলা চালাননি।
তার এমন নির্দেশের পর ইউক্রেনের ওই দুটি ভূখণ্ডে দেখা গেছে সেনাদের ট্যাঙ্ক গর্জন করছে রাজপথে। তাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছেন কেউ কেউ। এমনই ভয় পাচ্ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনসহ পশ্চিমা নেতারা। সোমবার বরিস জনসন বলেছেন, পুতিনের পরিকল্পনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ বলেছেন, ইউক্রেনে শুরু হয়ে গেছে রাশিয়ার আক্রমণ। আসলেই ইউক্রেনের ভূখণ্ড- দোনেৎস্ক এবং লুহানস্কের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে সেনা পাঠানোটাই হলো সামরিক আগ্রাসন। এখানে পুতিন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ইউরোপ, পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা কি হয় তা দেখার বিষয়।
নিষেধাজ্ঞা পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা করছিল যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা অনেক দেশ। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ নিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কিকে ফোন করেন। এতে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে দ্রুত নিষেধাজ্ঞা দেবে। তিনি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব বজায় থাকবে বলেও আশ্বাস দেন জেলেনস্কিকে। এ ছাড়া হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন এবং জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজের সঙ্গেও আলোচনা করছেন।
নর্ড স্ট্রিম ২ প্রকল্প স্থগিত করেছে জার্মানি
এরই মধ্যে ‘রাশিয়ার বৈষম্যমূলক’ আচরণের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। অন্যদিকে রাশিয়া থেকে যাওয়া বিশাল গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি।
৫ ব্যাংক ও ৩ ব্যক্তির বিরুদ্ধে বৃটেনের নিষেধাজ্ঞা
ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়া স্বীকৃতি দেয়ার পর রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। সোমবার তিনি এই ঘোষণা দিলেও গতকাল মঙ্গলবার রাশিয়ার পাঁচটি ব্যাংক ও তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছেন। এসব ব্যাংক হলো-রোশিয়া, আইএস ব্যাংক, জেনারেল ব্যাংক, প্রোমসভাইয়াজ ব্যাংক এবং ব্ল্যাক সি ব্যাংক। এ ছাড়া তিনজন উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম গেন্নেডি টিমচেনকো। এসব ব্যক্তির আছে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বৃটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ। স্কাই নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আপনি ধরে নিতে পারেন- ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। রাশিয়া এরইমধ্যে ইউক্রেনের মধ্যে ট্যাংক ও সেনা পাঠিয়েছে। আমরা দেখেছি, রুশ প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের দুটি পূর্বাঞ্চলীয় অংশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমরা এখনই বলতে পারি যে, রাশিয়া সেখানে ট্যাংক ও সেনা মোতায়েন করেছে। তাই আমার ধারণা এ থেকেই উপসংহার টানা যায় যে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরু হয়েছে।
ইউক্রেনকে ন্যাটোর সামরিক সমর্থন দেয়ার প্রস্তাব
ইউক্রেন ইস্যুতে বৃটিশ সরকারের উদ্যোগে সমর্থন জানিয়েছেন রক্ষণশীল কনজারভেটিভ পার্টির এমপি তোবিয়াস এলউড। তবে বলেছেন, এ ইস্যুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাই যথেষ্ট নয়। টার্গেটেড নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে তা পুতিনের হাতের খেলা হতে পারে। এতে চীনের আরও কাছাকাছি চলে যেতে পারে রাশিয়া। হাউজ অব কমন্সে প্রতিরক্ষা বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান তোবিয়াস এলউড আরও বলেছেন, ন্যাটো সীমান্তের বাইরে ইউরোপিয়ান দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তিনি নো-ফ্লাই জোন ঘোষণার ওপরও জোর দেন। জবাবে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এলউড ন্যাটো ইস্যুতে সঠিক অবস্থানে। সামরিক জোট তার পূর্বপ্রান্তকে শক্তিশালী করেছে। তিনি আরও বলেন, ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশই এখন ইউক্রেনে যুদ্ধ করার জন্য সেনা পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে না। ওদিকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল সমর্থন এবং প্রধানমন্ত্রী জনসনের বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। তিনি মনে করেন ইউক্রেন পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে এমন এক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে যে, কর্র্তৃত্ববাদী সরকারগুলো অন্যদের ওপর তাদের নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে চাপিয়ে দিচ্ছে। ‘এখন আমরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি তা হলো গণতন্ত্রকে রক্ষা করা।
নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র-পুতিনের মন্তব্য কাণ্ডজ্ঞানহীন
সোমবার রাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড জরুরি বৈঠকে ইউক্রেন ইস্যুতে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, মস্কোপন্থি ওই দুটি অঞ্চলের স্বীকৃতি দিয়েছেন পুতিন। তার এই উদ্যোগ আরও আগ্রাসনের প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছে। পুতিন দাবি করেছেন ওই অঞ্চলে ‘শান্তিরক্ষী’ হিসেবে রাশিয়ান সেনারা প্রবেশ করছে। তার এই মন্তব্য একেবারে ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ বা ননসেন্স। থমাস গ্রিনফিল্ড বলেন, আমরা জানি, তারা আসলে কে। তার দাবি, রুশ পদক্ষেপের কারণে ইউক্রেনসহ সমগ্র ইউরোপ ও বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ পরিণতি হবে। লিন্ডা থমাস বলেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন মিনস্ক চুক্তিকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন। তিনি এখানেই থামবেন বলেও কোনো বিশ্বাস নেই। জাতিসংঘে নিযুক্ত রুশ দূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, কূটনৈতিক সমাধানের জন্য আমরা সম্মত। তারপরও ডনবাস এলাকায় নতুন রক্তপাত আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
তবে বক্তব্যে নিরপেক্ষ ছিলেন চীনের দূত। জ্যাং জুন বলেন, উদ্বিগ্ন সব পক্ষকে অবশ্যই ধৈর্যের চর্চা করতে হবে এবং উত্তেজনায় বাড়াতে পারে এমন পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। কূটনৈতিক সমাধানের জন্য সব উদ্যোগকে বেইজিং স্বাগত জানাবে এবং উৎসাহ জোগাবে। তবে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাঁ মনে করেন, ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে দেশটির সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করেছে রাশিয়া। এ ছাড়া ভ্লাদিমির পুতিনের এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক প্রধান রোজম্যারি ডি-কার্লো।
এসব নিয়ে অনলাইন সিএনএনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলকে নিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়াকে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি মস্কোপন্থি দোনেৎস্ক এবং লুহানস্কের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে ডিক্রিতে স্বাক্ষরের কয়েক ঘণ্টা পর ওই অঞ্চলে ‘শান্তিরক্ষী’ আহ্বান করেছেন। ওই দুটি অঞ্চলে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন। পশ্চিমারা কয়েক সপ্তাহ ধরে রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে সতর্কতা দিয়ে আসছেন। ফলে পুতিনের এই সেনা মোতায়েন সেই আগ্রাসনের সূচনা কিনা তা পরিষ্কার হওয়া যায়নি। কারণ, তিনি আগ্রাসন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বহু কর্মকর্তা পুতিনের সোমবারের এ উদ্যোগ নিয়ে সতর্কতা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, এর মধ্য দিয়েই ইউক্রেনে বৃহৎ আকারে সামরিক অভিযান শুরু হয়ে থাকতে পারে।
এর আগে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন ভ্লাদিমির পুতিন। এতে তিনি পশ্চিমাদের সঙ্গে ইউক্রেনের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সম্পর্ক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, একটি সত্যিকার দেশ হওয়ার কোনো ইতিহাস নেই ইউক্রেনের।
তথ্য সূত্র : mzamin