Image default
আন্তর্জাতিক

বনবাসী নির্জন বৃদ্ধের জীবন

সিঙ্গাপুরের এক গহিন বন। চারদিকে গাছপালা আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা। এরই মাঝে বাঁশ, কাঠ ও পলিথিন দিয়ে বানানো ছোট্ট একটি তাঁবু। এর ভেতরেই জীবনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের উপকরণ নিয়ে থাকেন ৭৯ বছর বয়সী ওহ গো সেং। প্রকৃতি থেকেই তিনি সংগ্রহ করেন, যা কিছু প্রয়োজন। ঝাঁ চকচকে অট্টালিকার দেশে কেন বনের ভেতর বাস—সে রহস্যে পরে আসছি।

পরিবার-পরিজন ছাড়া গহিন বনের ভেতর আপনি কত দিন থাকতে পারবেন? শখ করে হয়তো এক দিন, এক সপ্তাহ! তারপর? প্রশ্নটা উঠছে কারণ, ৭৯ বছর বয়সী সেং অট্টালিকার লোভ ও স্বজনদের ফেলে টানা ৩০ বছর বনের ভেতর বাস করছেন। প্রকৃতির ভেতরে থেকে তিনি আর ১০ জনের চেয়ে বেশ সুস্থ ও সবলভাবেই জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি সেংয়ের এই অবাক করা ঘটনা ভাইরাল হয়ে গেছে। আর এ ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ হওয়ায় একের পর এক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাঁকে।

বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওহ গো সেং সিঙ্গাপুরের সানগেই তেনগা জেলার একটি গ্রামে পরিবারের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন। ১৯৮০ সালের দিকে ওই গ্রামসহ পুরো জেলা উন্নত হতে শুরু করে। বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ হতে থাকে।

সরকার ওই গ্রামের বাসিন্দাদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়। কিন্তু কোনো এক কারণে সেং নিজের জন্য কোনো ফ্ল্যাট নিতে পারেননি। তাঁর ভাই সরকারি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পান। ওই ফ্ল্যাটে সেংকে থাকার জন্য তাঁর ভাই প্রস্তাব দেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের বোঝা হয়ে থাকতে রাজি হননি সেং। এ কারণে আপনজনদের ছেড়ে তিনি ওই গহিন বনের ভেতর চলে যান। এই বনের কাছেই একসময় ছিল তাঁদের পুরোনো বাড়ি। সেখানে কাঠ, বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটাতে শুরু করেন। সেই যে এসেছেন বনে, আর ফিরে যাননি। বনের ভেতর টানা ৩০ বছর কেটে গেছে তাঁর। খাবারদাবার সবকিছু প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করেন। তাঁবুর পাশে নিজেই রান্না করে খেয়ে নেন। সেই খাবার খেয়েই আর দশজনের চেয়ে বেশ সুস্থ-সবলভাবেই বেঁচে আছেন সেং।

তাঁবুর সামনের জায়গায় সবজির চাষ করেন সেং। সেই সবজিই তিনি খান। এ ছাড়া বন পেরিয়ে পাশের লোকালয়ে কিছু সবজি ও বনের ফলফলাদি বিক্রি করেন। সেই অর্থে নিজের প্রয়োজন মেটান। বনবাসী হওয়ার পর একা একাই জীবন পার করে দিচ্ছেন তিনি।

বনের ভেতর একা একা এত বছর ধরে থাকেন কষ্ট হয় না—এমন প্রশ্নের জবাবে সেং বলেন, ‘নাহ।’ এই যে তাঁবুর সামনে বিশাল কাঁঠালগাছ ছায়া দিচ্ছে। সিঙ্গাপুরের মানুষ যখন চরম গরমে অতিষ্ঠ, তখন এই গাছের ছায়ায় বসে আরামে দিন কাটে তাঁর।

নির্জন বনের ভেতর নিজেকে কখনো একা মনে হয় না—এর জবাবে সেং বলেন, একাকিত্ব জীবনে কোনো বড় সমস্যা নয়। এ ছাড়া বাগান ও সবজি চাষ করে তিনি নিজেকে বেশ ব্যস্ত রেখেছেন। জীবনের একাকিত্বকে ঘুচিয়ে দিতে পারে ব্যস্ততা। সেটা তাঁর আছে।

বনে থাকার একটা অসুবিধার কথা জানিয়েছেন সেং। আর সেটা হলো—ইঁদুরের উৎপাত। তিনি বলেন, ‘কী করে যেন বনের ইঁদুর আমার তাঁবু চিনে যায়। আর তাঁবুতে যে কয়টা পোশাক আছে, তা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়ে নেয়। এটাই বড় সমস্যা।’

সবজি বিক্রি করা অর্থ দিয়ে সেং মাঝে মাঝে বন লাগোয়া সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশ ইন্দোনেশিয়ার ছোট্ট দ্বীপ বাটামে ঘুরতে যেতেন। সেখানেই মাদাম তাচিহ নামের এক নারীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেই পরিচয় একসময় প্রেমে গড়ালে বিয়ে করেন তাঁরা। সেং ও মাদাম তাচিহর একটি কন্যাসন্তান আছে। তার বয়স এখন ১৭। প্রতি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাটাম দ্বীপের ফেরিতে তাঁদের দেখা হতো। তবে করোনা মহামারিতে সিঙ্গাপুর সব সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় তাঁর বাটাম ভ্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া এখন সীমান্ত পেরিয়ে যেতে চাইলে নিজেকে কোভিড টেস্ট ও কোয়ারেন্টিনের খরচ দিতে হয়। এই অতিরিক্ত খরচের কারণেও বাটাম যাওয়া তাঁর বন্ধ হয়ে যায়।

দীর্ঘদিন স্ত্রী মাদাম ও কন্যার সঙ্গে তাঁর দেখা নেই। তাঁরা থাকেন ইন্দোনেশিয়ার একটি শহরে। তবে কীভাবে থাকেন, তা তিনি জানেন না। তিনি প্রতি মাসে তাঁদের কাছে ৩০ থেকে ৩৮ হাজার টাকা (৫০০-৬০০ সিঙ্গাপুর ডলার) পাঠানোর চেষ্টা করেন।
সেংয়ের একজন স্বজন বলেন, ‘দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে সেং বাইরে থাকেন। কোনো সাক্ষাৎ নেই। আমরা জানি, তিনি কোনো এক বাগানে কাজ করেন।’

চলতি মাসে সেংয়ের এই বিস্ময়কর ঘটনা প্রথম বাইরের দুনিয়ায় জানাজানি হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে এ ঘটনা। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—কেন তাঁকে সাহায্য করা হয়নি। এই অট্টালিকার দেশে কীভাবে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি ৩০ বছর ধরে বনের ভেতর জীবন যাপন করতে পারলেন।

চলতি মাসের শুরুর দিকে দেশটির একজন কর্মকর্তা দেখতে পান, বনের পাশের লোকালয়ে অনুমতি ছাড়া, অবৈধভাবে সবজি বিক্রি করছিলেন একজন বৃদ্ধ। পরে তাঁকে আটক করে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। সেং সব খুলে বলেন। তিনি সেংয়ের এই গল্প ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট করলে তা ভাইরাল হয়ে যায়। বিষয়টি ওই এলাকার পার্লামেন্ট সদস্য লিয়াং এং হোয়ার নজরে আসে। পরে তিনি সেংকে বন থেকে লোকালয়ে-শহরে নিয়ে আসেন।

লুনার নিউ ইয়ারের প্রথম দিন পার্লামেন্ট সদস্য লিয়াং এং হোয়ার তত্ত্বাবধানে সেংকে একটি নতুন বাড়ি উপহার দেওয়া হয়েছে। লিয়াং এং হোয়া বলেন, তাঁর টিমের সদস্যরা সেংয়ের নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন। সামাজিকভাবে তাঁকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেংকে একটি এক বেডরুমের ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। আরেকজনের সঙ্গে সেটি ভাগাভাগি করে থাকছেন। তাঁর জীবনের এই গল্প শুনে অনেকেই ওই বাসায় ফ্রিজ, টেলিভিশন, কেটলি ও ওয়াটার হিটার উপহার পাঠিয়েছেন। ওয়াটার হিটার পেয়ে সেং বেশ খুশি। তাঁকে গাড়িচালকের কাজও দেওয়া হয়েছে। গাড়ি চালিয়ে বিদেশি শ্রমিকদের আনা-নেওয়া করা তাঁর কাজ। সময় পেলে বাগান করার সুযোগও আছে তাঁর।

লোকালয়ে ফিরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সেং। প্রায় ৩০ বছর পর পরিবারের সদস্যদের দেখে আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। স্বজনেরা তাঁর জন্য অনেক পদের রান্না করেছিলেন। অনেক দিন পর পেটপুরে খেয়েছেন সেদিন।

সেং বলেন, ‘আমাকে একটি টিভি দেওয়া হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, গত ৩০ বছরের বেশি সময় পর এই প্রথম আমি টিভি দেখলাম। এটা খুবই ভালো লাগছে।’
অনেক দিন পর এই ফ্ল্যাট–জীবনও ভালো লাগছে তাঁর। তবে লোকালয়ে ফিরলেও নিজের বনবাসী জীবনের স্বাধীনতার কথা খুব মনে পড়ে। এখনো প্রতিদিন ভোর তিনটায় ঘুম থেকে উঠে তিনি বনে যান। নিজ হাতে লাগানো সবজিগাছের পরিচর্যা করে আবার ফিরে এসে কাজে যোগ দেন।

সিঙ্গাপুরে গৃহহীন মানুষের দেখা পাওয়া প্রায় বিরল। সেই দেশেই সেংয়ের মতো মানুষ টানা ৩০ বছর বনে বাস করছেন। বিষয়টা সত্যিই বিস্ময়কর। সেংয়ের জীবনের ৩০ বছরের গল্প জানা গেলেও পরিবার-পরিজন ছাড়া কেন, কোন অভিমানে এবং কিসের টানে গহিন বনের ভেতর টানা ৩০ বছর বনবাস, সেই রহস্য এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।

Related posts

মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান যাচ্ছেন রাশিয়া সফরে

News Desk

মমতার মন্ত্রিসভায় রদবদল আসছে, বাদ পড়ছেন কয়েকজন

News Desk

খনিতে মিলল ৩০০ বছরের দুর্লভ গোলাপি হীরা

News Desk

Leave a Comment