দুইশ বছরের পারিবারিক পেশায় পঞ্চম প্রজন্মের সুকান্ত
ইতিহাস

দুইশ বছরের পারিবারিক পেশায় পঞ্চম প্রজন্মের সুকান্ত

শাহীনূর সরকার

কাঁসা পিতল। আগেকার দিনে রান্না ও খাবার পরিবেশনে অভিজাত পরিবারগুলোতে এসব ধাতুর তৈজসপত্রই ব্যবহার হতো। ইতিহাস পড়লে এমনকি বিভিন্ন জাদুঘর ঘুরলেও বোঝা যায় সেইসময়ে ঘর সাজানোর নানা পণ্য ও ভাস্কর্যেও ছিল এসব ধাতুরই আধিপত্য। স্বর্ণ ও রূপার পরই ছিল কাঁসা পিতলের স্থান। তাই এ শিল্পের কদরও ছিল বেশ।

তবে সংস্কৃতির পালাবদল আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঁসা পিতলের জায়গা দখল করেছে চিনামাটি, স্টিল, প্লাস্টিক। এসব পণ্য বেশ সহজলভ্য হওয়ায় তামা, কাঁসা কিংবা পিতলের সেই দিন আর নেই। আর তাই এসব শিল্পীদেরও কদর নেই। বিলুপ্ত হতে বসেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঁসা পিতল শিল্প।

মূলত পাল রাজাদের সময় থেকেই উৎকর্ষতা পায় এ শিল্প। রাজধানীর পাশের জেলা ধামরাই কাঁসা-পিতলের জন্য তখন থেকেই বিখ্যাত ছিল। দেশের বিভিন্ন জায়গার রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি থেকে শুরু করে বিদেশেও চলে যেত এখানকার তৈরি কাঁসা পিতলের পণ্য। তাই সারাদিন ব্যস্ততা ছিল এই জনপদে। সড়ক দিয়ে হেঁটে গেলে আশপাশের প্রতিটা বাড়ি থেকে কাঁসা পিতলের টুংটাং টুংটাং শব্দ হতো। কারখানাগুলোতে প্রতিদিন ঢালাই হতো, গলানো হতো ধাতু। কাঁসা পিতলের তৈরি নানান জিনিসপত্র তৈরি করে নিয়ে আসা হতো মহাজনদের ঘরে।

তেমনি একটি বাড়ি ধামরাই রথের পাশে সুকান্ত বণিকের বাড়ি। প্রায় ২০০ বছর ধরে এই বাড়ির বংশধরেরা কাঁসা পিতল শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বিশ্বকর্মা খ্যাত শিল্পী সুকান্ত পঞ্চম প্রজন্ম। ধামরাইয়ের কাঁসা পিতল শিল্পের পুরনো জৌলুস না থাকলেও সুকান্ত পিতলের ভাস্কর্যের মাধ্যমে এই শিল্পকে দিয়েছেন বিশ্ব পরিচিতি।

দুইশ বছরের পারিবারিক পেশায় পঞ্চম প্রজন্মের সুকান্ত

সারাবাংলাকে সুকান্ত জানান, ‘এই এলাকায় প্রতিদিনই এই কাজ নিয়ে মানুষের যে কর্মব্যস্ততা এটা পরিলক্ষিত হতো। সাধারণত সোমবার ও মঙ্গলবার দিন ধামরাইতে হাট বসে। সেই হাটের দিন কারিগরকে টাকাপয়সা দেওয়া হতো। সেই টাকা দিয়ে সে বাজারের বড় মাছ কিনতে পারতো। একটা অন্যরকম পরিবেশ ছিল এই শিল্পের। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষজন যেমন টাকা রোজগার করতে পারতো, তেমনি কাঁসা পিতলের শিল্পী হিসেবে তাদের সম্মানও ছিল।’

বর্তমানে এ শিল্পের কারিগরই খুঁজে পাওয়া ভার। যারা এ পেশায় আছেন তাদের বেশিরভাগই বৃদ্ধ। খুব অল্প কাজ হওয়ায় এ পেশায় থেকে কারিগরদের সংসার চালানো খুবই কঠিন। তাই তরুণদের এ পেশায় আগ্রহ নেই। সুকান্ত জানান, ‘কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হতে হতে এখন নাই বল্লেই চলে। কাঁসা পিতল শিল্প এখন রুগ্ন শিল্প নয়, এটা একটা মৃত শিল্প। বয়স্ক লোকজন ছাড়া কাউকে কিন্তু কারখানায় দেখতে পাবেন না। তিন চারজনের ওপর কোন কারখানায় কাজ নেই। তিন চারজন লোক যে আমার কারখানায় কাজ করে। তাদের দেওয়ার মতো কাজ আমার কাছে নাই।’

দুইশ বছরের পারিবারিক পেশায় পঞ্চম প্রজন্মের সুকান্ত

আগেকার দিনে আভিজাত্যের প্রতীক তামা কাঁসার জিনিসপত্র সাধারণত জমিদারবাড়ি ও অভিজাত পরিবারগুলোতেই দেখা যেত। ধামরাইয়ের কয়েকশ বছরের প্রাচীন এই শিল্পের চাহিদা ছিল বিশ্বজুড়ে। তবে দেশভাগের পর থেকে শুরু হয় এর দুর্দিন। সুকান্ত বণিকের কাছ থেকে জানা যায়, কাঁসার তৈরি একধরনের বাটি যা দিয়ে মেডিটেশন করা হয়, সেই বাটি তৈরির মূল কারিগর ১৯৪৭ সালে ভারতে চলে যান। তখন থেকে এ শিল্পের দুর্দিন শুরু হয়। সারাবাংলাকে তিনি জানান, ‘আমাদের বাজারগুলো ছিল মূলত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। সেটা দেশভাগের পর বন্ধ হয়ে যায়। এর কারণে এখানে যে উৎপাদন প্রক্রিয়া সেটা ব্যহত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এই শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিটা বাড়ি ভাংচুর হয়েছে, লুটপাট হয়েছে। আমার জন্ম ১৯৭৩ সালে। কিন্তু আমার মায়ের কাছে শুনেছি, সেসময় তারা ভারতে চলে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তারা কলাপাতায় ভাত খেয়েছেন।’

স্বাধীনতার পর নতুন করে যাত্রা শুরু করে এ শিল্প। কাঁসা পিতল যেমন ধামরাই থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতো, তেমনি বিদেশিরাও এখান থেকে এগুলো কিনে নিয়ে যেতেন। তবে জমজমাট সেই যুগে আর ফিরতে পারে নি এ শিল্প। সুকান্ত বণিক পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছিলেন ২০০০ সালে। বলেন, ‘সেসময় কয়েকজন বিদেশি আমাকে সাহায্য করেছে। ট্রেডিশনার এই শিল্পের কারুকাজের ভ্যালু তাদের সঙ্গে না মিশলে বা তাদের উৎসাহ না পেলে বুঝতে পারতাম না। দেশের বাইরে যখন আমরা এ কাজগুলো তুলে ধরি, তখন কিন্তু বুঝতে পারি, কত অসাধারণ সুক্ষ্ম কারিগরি আমাদের এখানে আছে।’

দুইশ বছরের পারিবারিক পেশায় পঞ্চম প্রজন্মের সুকান্ত

সুকান্ত বণিকের ‘ধামরাই মেটাল ক্রাফট’ এ মূলত বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য তৈরি হয়। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে এ শিল্পের ব্যাপক চাহিদা আছে। তবে, এর সবচেয়ে বড় বাজার হতে পারে পাশের দেশ ভারত। কিন্তু কাস্টমস জটিলতার কারণে দেশের বাইরে এসব শিল্পপণ্য পাঠানো খুবই দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে সুকান্ত বলেন, ‘ভারত নেপাল থেকে এসব পণ্য দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য তেমন কোন জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। বেশিরভাগ পণ্যই কাস্টমস হয়ে দেশের বাইরে চলে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার পরই দেশের বাইরে পাঠানো যায়। যার জন্য মাসের পর মাস সময় লাগে। কিন্তু বায়ার এতদিন অপেক্ষা করে না।’

ধামরাইয়ে এখনো পাঁচ হাজার বছর আগের লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে। তিনি জানান, এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে ভালো কাজ হয়েছে পাল রাজাদের সময়ে। সেই কাজগুলো ফিরিয়ে আনতে পারলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে, কতটা সম্মৃদ্ধ ছিল এ দেশ।

দুইশ বছরের পারিবারিক পেশায় পঞ্চম প্রজন্মের সুকান্ত

তামা কাঁসাকে রক্ষার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন সুকান্ত। বিদেশিদের সঙ্গে স্কিল এক্সচেঞ্চ প্রোগ্রাম করেছেন, আমেরিকার সহায়তায় কাঁসা পিতলের ওপর ডকুমেন্টরি করেছেন। তবে প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের জোরালো উদ্যোগ। তিনি বলেন, ‘আসলে এগুলো খুবই ছোট, সাধারণ কাজ। তবে, সরকারি, বেসরকারিভাবে ‌উদ্যোগ নেওয়া উচিত, এই শিল্পটা একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগে অন্তত ডকুমেন্টেশন করে রাখা দরকার। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম এই কাজগুলো দেখতে পারে, বুঝতে পারে এবং জানতে পারে। আমাদের এই নৈপুণ্য, দক্ষতা, মননশীলতা কিন্তু আগামী প্রজন্মের মানুষকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদান রাখার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করবে।’

সুকান্ত বণিক আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‌‌’খুব দুঃখ হয় যে, এতো সুন্দর এতো ভালো কাজের মূল্যায়ন এই দেশে নাই বললেই চলে। কারখানাতে যেখানেই আপনি যাবেন সব কিন্তু বয়স্ক মানুষজন। তারা যখন এই কাজ ছেড়ে দিবে বা করতে পারবে না তখন কিন্তু এই শিল্পটা ধরে রাখার জন্য কোন মানুষ থাকবে না। আবার হয়তো একটা সময় আসবে যখন এই কাঁসা পিতলের মূল্য মানুষ বুঝবে এবং ফিরিয়ে আনতে চাইবে। তখন কিন্তু এই মসলিন যে এখন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, এইটার মতোই অনেক কঠিন হয়ে যাবে এই জিনিসটা ফিরিয়ে আনা।’

ধামরাইয়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে যেসব কাজ হয় তা ডকুমেন্টেশন করে রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি। যাতে অন্তত বইয়ে হলেও আমাদের যে ঐতিহ্যবাহী শিল্পের অস্তিত্ব তা থাকে। এ শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজের বাড়িতে একটি জাদুঘর করতে চান সুকান্ত বণিক। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, সেই জাদুঘরে আমাদের আগের যে জিনিসগুলো তৈরি হতো এবং যে জিনিসগুলো এখন তৈরি হয়, সেগুলো থাকবে। পাশাপাশি যে পাঁচটা পদ্ধতিতে এখানে কাজ হয় সেগুলোর বর্ণণা থাকবে যাতে মানুষজন এসে জানতে পারে, শিখতে পারে। তার যে শিকড়, সেই শিকড়ের কাছে যেন সে যেতে পারে।

দুইশ বছরের পারিবারিক পেশায় পঞ্চম প্রজন্মের সুকান্ত

পাঁচ হাজার বছর পুরোনো ‘লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতি’
সুকান্তের কারখানায় মূলত কাজ হয় লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে। এটি পাঁচ হাজার বছর আগের একটা পদ্ধতি। এইপদ্ধতিতে যাই তৈরি করতে চান না কেন প্রথমে একটি মডেলটা মন দিয়ে বানাতে হবে।

তিনি সারাবাংলাকে জানালেন এ পদ্ধতিতে কীভাবে তারা নানান পণ্য তৈরি করেন। যে মোমটা ব্যবহার করা হয় সেটা মৌচাকের মোম ও প্যারাফিনের একটা মিশ্রণ। এটিকে গলিয়ে সম্পূর্ণ হাত দিয়ে মডেল তৈরি করা হয়। তারওপর তিন ধরনের মাটির আস্তর দিতে হয়। এরপর লেয়ার বাই লেয়ার মাটিগুলো এর ওপর দিতে হয় ডাইস বানানোর জন্য। তিনটা লেয়ারে মাটি দেওয়া হয়ে গেলে সাচ তৈরি হয়ে গেলো। সেটি চুলাতে পোড়ানো হয়। তখন মাটি গরম হয়ে ভেতর থেকে মোম গলে বের হয়ে আসে। কিন্তু মোমের যে ডিজাইন সেটা মাটির মধ্যে থেকে যায়। পিতলটা গলিয়ে এরমধ্যে ঢেলে দিলে মোমের যে আদল সেটা পিতলে চলে আসে। তারপরে এটাকে ঠান্ডা করে মাটি ভেঙ্গে বের করতে হয়। এরপর চলে ঘষামাজার কাজ।

যখন পোড়ানো হয় তখন মোমটা হারিয়ে যায় বলেই এ পদ্ধতিকে লস্ট ওয়াক্স বলা হয়। আর সম্পূর্ণ হাত দিয়ে মডেলটা তৈরি করা হয় বলে প্রত্যেকটি পণ্য একেকটি থেকে আলাদা। কারিগর নিজের কাজ কপি করলেও একটা থেকে হুবহু দুইটা কখনোই হয় না।

এসব কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ১৫ দিনের মতো সময় লাগে। কিন্তু বড় কাজগুলো করতে মাসের পর মাস সময় লেগে যায়।

দুইশ বছরের পারিবারিক পেশায় পঞ্চম প্রজন্মের সুকান্ত

কাঁসা নাকি পিতল, কোনটি বেশি স্বাস্থ্যসম্মত
কাঁসা হচ্ছে রাং ও তামার একটি মিশ্রণ। আর পিতল হচ্ছে তামা ও দস্তার মিশ্রণ। ধামরাইয়ে দু’ধরনের ধাতুতেই কাজ হয়। তবে কোন ধাতুর তৈজসপত্র ব্যবহার করা বেশি স্বাস্থ্যসম্মত?

এ ব্যাপারে সুকান্ত বণিক বলেন, দুটোই ব্যবহার করা যায়। তবে পিতলের পাত্রে টকজাতীয় কোন জিনিস রাখা যায় না। কিন্তু কাঁসার পাত্রে সব ধরনের খাবারই রাখা যায়।

সারাবাংলা/এসএসএস

Source link

Related posts

ABCD আবিষ্কার হল কী ভাবে, করলেনই বা কে?

News Desk

একাত্তরের জন্মদিনে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি

News Desk

শ্রীকৃষ্ণ: শান্তির দূত, ধর্মের সংস্থাপক

Sanjibon Das

Leave a Comment