নৌকায় করে অনিশ্চিত জীবনযাত্রা ছিল অস্কারজয়ী কোয়ানের পরিবারের
বিনোদন

নৌকায় করে অনিশ্চিত জীবনযাত্রা ছিল অস্কারজয়ী কোয়ানের পরিবারের

অস্কারের ৯৫তম আসরে পার্শ্বচরিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতেছেন অভিনেতা কে হুই কোয়ান। ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ানস’ সিনেমার জন্য প্রথম কোনো ভিয়েতনামী বংশোদ্ভূত অভিনেতা হিসেবে অস্কার জিতলেন তিনি। পুরস্কার জয়ের পর আবেগাপ্লুত কে হুই কোয়ান পেছন ফিরে তাকান। ভিয়েতনাম থেকে হংকংয়ের শরণার্থীশিবির, সেখান থেকে নৌকায় ক্যালিফোর্নিয়া- এক শরণার্থী পরিবারের অনিশ্চিত এক যাত্রা।

কোয়ানের জীবন শুরু হয় একটি নৌকায়। একটি শরণার্থীশিবিরে থেকেছিলেন এক বছর। সেই সময়টি থেকে আজকের অস্কারের মঞ্চে পুরস্কার হাতে দাঁড়ানো–এ যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কোয়ান।

পুরস্কার ঘোষণার পর ৫১ বছর বয়সী এ অভিনেতা অস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘অনেকেই ভাবেন এই ধরনের গল্প শুধু সিনেমাতেই ঘটে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এটা আমার সঙ্গে ঘটছে। এটি একটি আমেরিকান স্বপ্ন।’

নিজের সংগ্রামের দিনগুলো স্মরণ করে কোয়ান বলেন, ‘একটা সময় জীবন আমাকে উদ্বাস্তু বানিয়ে রেখেছিল। আমার মাথার ওপর ছাদ ছিল না। অনিশ্চিত এক জীবন ছিল আমার। কিন্তু আজ আমি বিশ্বাস করি এমন প্রতিকূলতা থেকেই মানুষ অস্কার, অলিম্পিক পদক কিংবা নোবেল পুরস্কারও পেতে পারেন। তাই হাল না ছেড়ে আরও একবার ভাবুন। আমি এই অস্কার আমার স্ত্রী ইকোকে উৎসর্গ করতে চাই। তিনিই আমাকে ২০ বছর ধরে ক্রমাগতভাবে বলে গিয়েছিলেন, একটা দিন আসবেই যেদিন আমি এই ভাবে আপনাদের সামনে অস্কার হাতে দাঁড়িয়ে থাকব। স্বপ্ন দেখলে, তা সত্যি করায় বিশ্বাস করতে হয়। আমি হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম প্রায়…’

‘দ্য গুনিজ’ এ শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন কোয়ান। ছবি: সংগৃহীত পুরস্কার গ্রহণের পর মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কোয়ান বলেন, ‘আমার মায়ের বয়স ৮৪ বছর। তিনি নিশ্চয়ই বাড়িতে বসে আমাকে দেখছেন। মা, আমি এইমাত্র একটি অস্কার জিতেছি।’ 

 ১৯৭১ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভিয়েতনামে জন্ম কোয়ানের। ৯ জন ভাই-বোনের বিশাল এক পরিবার নিয়ে ১৯৭৮ সালে কোয়ানের পরিবার পালিয়ে আসে সাইগনে। সেখানে তাঁদের মানবতর জীবন শুরু হয় নৌকায়। কোয়ানরা ছিল চীনা সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হোয়া সম্প্রদায়ের। ভিয়েতনামের সংখ্যাগরিষ্ঠরা নিপীড়ন চালায় তাঁদের ওপর। সেই সময় হোয়া সম্প্রদায়ের অনেকেই ভিয়েতনাম থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ছোট-ছোট নৌকোয় ঠাঁই নিয়েছিলেন তারা। সামুদ্রিক ঝড়, জলদস্যুদের আক্রমণের সম্মুখীন হয় সেই সব ছোট নৌকো।

এভাবে পালিয়েই কোয়ানের মা এবং আরও তিন ভাই-বোন মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন। কোয়ান, তাঁর বাবা এবং পাঁচ ভাই-বোন পৌঁছেছিলেন হংকংয়ে। ৮ লক্ষ উদ্বাস্তুর মতো তাঁদের পরিবারের পালিয়ে আসাও সফল হয়েছিল সেই সময়। ইউনাইটেড নেশনের হাইকমিশনার ফর রেফিউজিসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২ থেকে ৪ লক্ষ উদ্বাস্তু সেই বার সমুদ্রেই মারা গিয়েছিলেন। গোটা এক বছর কোয়ান পরিবার বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্পে থাকতে শুরু করে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা উদ্বাস্তুদের তাঁদের দেশে ঠাঁই দেওয়ার ঘোষণা দেন। এভাবেই ক্যালিফোর্নিয়ায় ফের মিলিত হয় কোয়ান পরিবার।

কোয়ান অভিনয় জগতে পা রাখেন শিশু শিল্পী হিসেবে। ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য টেম্পল অব ডুম-এর সেই ‘শর্ট রাউন্ড’ চরিত্রে অভিনয় করা ১১ বছরের ছেলেটার কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। যে হ্যারিসন ফোর্ডের সঙ্গী হয়ে অমরেশ পুরীর আস্তানায় ঢুকে অশুভ পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছিল। ১৯৮৪ সালে সিনেমাটির পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ প্রায় ৬০ হাজার ছেলের মধ্য থেকে শর্ট রাউন্ড চরিত্রটির জন্য বেছে নিয়েছিলেন কে হুই কোয়ানকে। সেখান থেকে নির্বাচিত হয়ে পরের বছর ‘দ্য গুনিজ’ এ শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন তিনি। আর একটু বড় হতেই আরও বেশি অভিনয়ের প্রস্তাব পেতে শুরু করেছিলেন কোয়ান। কিন্তু অভিনয়ে কম সময় দিয়ে কোয়ান বহু সিনেমায় স্টান্ট কোরিওগ্রাফার ও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরবর্তীকালে জন এম চু পরিচালিত কমেডি সিনেমা ‘ক্রেজি রিচ এশিয়ান’ থেকে পুনর্বার অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছোটার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

  অস্কার মঞ্চে কোয়ান। ছবি: এএফপি ২০১৮ সালে ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’ সিনেমায় কাজের প্রস্তাব পেয়ে কোয়ানের জীবনের মোড় ঘোরে যায়। তিনি ভিয়েতনামী বংশোদ্ভূত প্রথম ব্যক্তি যিনি অস্কার জিতেছেন, এবং এই বছর মনোনীত দুজনের মধ্যে একজন-অন্যজন ছিলেন দ্য হোয়েলের হং চাউ, যার পরিবারও ভিয়েতনাম থেকে নৌকায় করে পালিয়েছিল।

এবারের অস্কারে সেরা সিনেমার পুরস্কার জিতে নেয় ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’। ৯৫ তম অস্কার আসরে সর্বোচ্চ ১১টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিল সিনেমাটি। একজন নারীকে কেন্দ্র করে নির্মিত অ্যাডভেঞ্চারধর্মী সিনেমা সব মিলিয়ে এবারের আসরে সাতটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছে। সেরা সিনেমা ছাড়াও ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’-এর পরিচালক ড্যানিয়েল কোয়ান ও ড্যানিয়েল শেইনার্ট সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন। সিনেমার প্রধান অভিনেত্রী মিশেল ইয়ো পেয়েছেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার।

যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ডলবি থিয়েটারে জমকালো আয়োজনে অস্কারের ৯৫ তম আসরের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ২৩টি শাখায় পুরস্কার বিতরণের আয়োজন শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের সময় গত ১২ মার্চ রাত ৮টায় (বাংলাদেশ সময় গত ১৩ মার্চ ভোর ৬ টা)। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করছিরেন জিমি কিমেল। 

Source link

Related posts

অস্কারের সদস্যপদ ত্যাগ করলেন উইল স্মিথ

News Desk

পরীমণির অভিযোগ অস্বীকার করলেন জায়েদ খান

News Desk

আলোচনায় ছিল হিন্দি ওয়েব কনটেন্ট

News Desk

Leave a Comment