যেভাবে আসামে হিন্দু-মুসলিম বিভাজিত সমাজে ঐক্যের সুর হয়ে উঠলেন জুবিন গার্গ
বিনোদন

যেভাবে আসামে হিন্দু-মুসলিম বিভাজিত সমাজে ঐক্যের সুর হয়ে উঠলেন জুবিন গার্গ

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের সংগীত জগতে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান কিংবদন্তি গায়ক জুবিন গার্গ। সিঙ্গাপুরের লাজারুস দ্বীপের কাছে স্কুবা ডাইভিংয়ের সময় অসুস্থ হয়ে মারা যান তিনি।

৫২ বছর বয়সী এই শিল্পী, আসাম ও বাইরের লাখ লাখ ভক্তের কাছে পূজনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে গোটা রাজ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সিঙ্গাপুরে ‘নর্থইস্ট ইন্ডিয়া ফেস্টিভ্যাল’-এ পারফর্ম করার কথা ছিল তাঁর। জুবিনের স্ত্রী গরিমা সাইকিয়া গার্গ এক বিবৃতিতে জানান, সমুদ্রে সাঁতার কাটার সময় জুবিন গার্গের খিঁচুনি শুরু হয়। খুব কম সময়ের মধ্যেই মারা যান তিনি।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও জাতীয় পরিচিতি

১৯৭২ সালে আসামের জোরহাট শহরে লেখক মোহিনী মোহন বরঠাকুর এবং গায়িকা ইলি বরঠাকুরের ঘরে জন্ম নেওয়া জুবিন মাত্র তিন বছর বয়স থেকেই গান গাওয়া শুরু করেন। শিক্ষকসহ অনেকের কাছেই তিনি ‘শিশু প্রতিভা’ হিসেবে গণ্য হতেন। ১৯৯২ সালে তাঁর প্রথম অসমিয়া অ্যালবাম ‘অনামিকা’ মুক্তির মাধ্যমে তাঁর পেশাদার কর্মজীবনের সূচনা হয়।

গুয়াহাটিতে প্রিয় শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল। ছবি: আল-জাজিরা

বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি ডজনখানেক ভাষা ও উপভাষায় ৩৮ হাজারের বেশি গান রেকর্ড করেন। ২০০৬ সালে বলিউড সিনেমা ‘গ্যাংস্টার: এ লাভ স্টোরি’র বিখ্যাত গান ‘ইয়া আলী’র মাধ্যমে তিনি জাতীয় স্তরে বিপুল পরিচিতি পান। পরের বছর তিনি একটি নন-ফিচার চলচ্চিত্রের জন্য গান কম্পোজ করে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। অভিনয় ও পরিচালনায়ও তাঁর পদচারণা ছিল।

ঐক্যের প্রতীক: ধর্ম ও ভাষার বিভেদ ঘোচানো কণ্ঠ

জুবিন গার্গের সংগীত এমন এক সময়ে হিন্দু-মুসলিম ও ভাষাগত বিভাজনের মাঝে ঐক্যের বিরল প্রতীক হয়ে উঠেছিল, যখন আসামে এই বিভেদ চরমে পৌঁছেছে। ট্রাকচালক ইমাম হুসেন (৪২)-এর মতো বাংলাভাষী মুসলিমরা, যাদের প্রায়শই ‘বহিরাগত’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে আক্রমণ করা হয়, তাঁরা জুবিনের (তিনি একজন হিন্দু) গানে শান্তি খুঁজে পেতেন। হুসেন বলেন, ‘তাঁর গান ছিল আমার ভেতরের শান্তি।’

জুবিনের মৃত্যুর পর এই ঐক্যের চিত্র আরও স্পষ্ট হয়। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাঁর গান বাজিয়েছে, আর মুসলিম নেতারা তাঁর ছবিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করেছেন—যা সাধারণত ইসলামি রীতিতে প্রচলিত নয়। আসামের বাঙালি-মুসলিম সম্প্রদায়ের গাওয়া ভক্তিমূলক লোকসংগীত ‘জিকির’ গেয়ে জুবিন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। তাঁর এই সর্বজনীন মনোভাব তাঁকে সব সম্প্রদায়ের কাছে প্রিয় করে তোলে।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবরার নাদিম বলেন, জুবিনের গান ‘এই মায়ার ধরাত’ (এই পার্থিব আনন্দের পৃথিবীতে) তাঁকে আধ্যাত্মিকতার কাছাকাছি এনেছিল। তিনি বলেন, অন্যায়-অবিচার করেও দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের ক্ষণস্থায়ী সুখভোগ, যা শেষে শূন্যতায় পর্যবসিত হয়—এই গানে সেই কথা বলা হয়েছে।

নাস্তিক, বামপন্থী ও প্রথাবিরোধী শিল্পী

জুবিন গার্গ বহুবার নিজেকে ‘নাস্তিক’ এবং ‘সামাজিক বামপন্থী’ (social leftist) হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি নিজেকে রাজ্যের মূলধারার রাজনৈতিক দল, কংগ্রেস বা বিজেপি থেকে দূরে রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতে গভীরভাবে প্রোথিত জাতিভেদ (বর্ণ) প্রথার কট্টর সমালোচক। তাঁর মৃত্যুর পর ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে তিনি বলেন, ‘আমি কেবল একজন মানুষ। আমার কোনো জাত, ধর্ম বা ঈশ্বর নেই। আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা।’

তাঁর এই প্রথা ভাঙার সাহস তাঁকে আসামের সাংস্কৃতিক জগতে এক ‘আইকনোক্লাস্ট’ (প্রথা বিরোধী) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। জুবিন মঞ্চে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করতেন, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গান গাইতেন এবং প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নিয়ম ও সংস্কৃতির প্রতি প্রায়শই স্পষ্ট বিরোধিতা দেখাতেন।

তিনি ২০১৯ সালে মুসলিমদের বাদ দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অমুসলিম অভিবাসীদের দ্রুত নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য প্রণীত বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। জাতিসংঘ এই আইনটিকে ওই সময় ‘মৌলিকভাবে বৈষম্যমূলক’ বলে অভিহিত করেছিল।

গুয়াহাটিতে প্রিয় শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল। ছবি: আল-জাজিরাগুয়াহাটিতে প্রিয় শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল। ছবি: আল-জাজিরা

রাজনৈতিক শোক ও উত্তরাধিকারের দাবি

জুবিন গার্গের প্রয়াণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা শোক প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘সংগীতে তাঁর সমৃদ্ধ অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’

গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অখিল রঞ্জন দত্ত মনে করেন, হিন্দু সংখ্যাগুরুত্ববাদী দল বিজেপির এই শোক প্রকাশের একটি কারণ রয়েছে। জুবিন গার্গ প্রকাশ্যে বিজেপি সরকারের নীতি ও কাজের সমালোচনা করলেও, তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাদের নেতাদের আক্রমণ করতেন না। দত্ত বলেন, ‘এতে বিজেপির পক্ষে তাঁর উত্তরাধিকারকে গ্রহণ করা সহজ হয়ে যায়, কারণ তাঁর প্রতি শোক প্রকাশ না করলে তারা জনগণের সমালোচনার মুখে পড়ত।’

অন্যদিকে, জুবিন গার্গ বাংলাভাষী মুসলিমদের কখনো খারাপভাবে চিত্রিত করেননি। তাঁর এই অসাম্প্রদায়িক অবস্থান তাঁকে এমন একজন শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, যিনি ঘৃণার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সবাইকে সমানভাবে গ্রহণ করেছেন।

রাষ্ট্রীয় সম্মান ও জনতার শ্রদ্ধা

জুবিন গার্গের আকস্মিক মৃত্যুতে আসাম সরকার চার দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। ২১ সেপ্টেম্বর, গুয়াহাটি বিমানবন্দরে তাঁর মরদেহ পৌঁছানোর পর, লাখ লাখ ভক্ত স্টেডিয়াম পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ শোক মিছিলে অংশ নেন। তাঁরা একযোগে তাঁর বিখ্যাত গানগুলো গাইতে গাইতে হাঁটেন। শোক শেষে ২৩ সেপ্টেম্বর পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এবং ২১ বার গান স্যালুটে তাঁকে দাহ করা হয়। এই দৃশ্যগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজ্যের ধর্মীয় ও ভাষাগত বিভাজনের মাঝে এক বিরল ঐক্যের মুহূর্ত তৈরি করে।

ট্রাকচালক হুসেন যখন জুবিনের ছবিযুক্ত টি-শার্ট পরে তাঁর বিখ্যাত গান ‘মায়া’ গুনগুন করছিলেন, তখন তাঁর কাছে জুবিনের সংগীতে হিন্দু-মুসলিম, অসমিয়া-বাঙালি নির্বিশেষে সবার জন্য আসাম—এই ধারণাটি নিয়ে কোনো বিভ্রম ছিল না।

Source link

Related posts

পরীমণির ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট, আইনি ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি মিমের 

News Desk

জুলাইতে আসছে কামার আহমাদ সাইমনের ‘অন্যদিন…’

News Desk

সালমান খানের মহানুভবতার গল্প জানালেন দিয়া মির্জা

News Desk

Leave a Comment