ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। ভারতীয় চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে যাচ্ছে ইতালির বোলোগনা শহর। আজ শুক্রবার (স্থানীয় সময়) ‘ইল সিনেমা রিট্রোভাটো’ উৎসবে বিশ্ব প্রিমিয়ার হতে যাচ্ছে রমেশ সিপ্পি পরিচালিত ১৯৭৫ সালের জনপ্রিয় হিন্দি ছবি ‘শোলে’র সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধারকৃত ও আনকাট সংস্করণ। পঞ্চাশ বছর আগে মুক্তি পেয়ে ভারতীয় সিনেমা জগতে যে ঝড় তুলেছিল ‘শোলে’, এই নতুন সংস্করণ সেই উন্মাদনা আবার ফিরিয়ে আনছে।
এই নতুন সংস্করণে দর্শকেরা দেখতে পাবেন ছবির আসল সমাপ্তি, যা সেন্সর বোর্ডের আপত্তির কারণে পরিবর্তন করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে কিছু বাদ পড়া দৃশ্যও থাকবে নতুন সংস্করণে। উৎসবের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ পিয়াজ্জা ম্যাগিওরে-তে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এটি ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম উন্মুক্ত মঞ্চ।
ভারতীয় সিনেমার ‘কারিপূর্বা’
চিত্রনাট্য লেখক জুটি সেলিম-জাভেদের হাতে রচিত, ‘শোলে’তে অভিনয় করেছেন সেই সময়ের সব বড় তারকারা—অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী, জয়া ভাদুড়ি, সঞ্জীব কুমার এবং গব্বর সিং চরিত্রে আমজাদ খান (প্রয়াত)। ছবিটি ওয়েস্টার্ন ও সামুরাই ক্ল্যাসিক থেকে অনুপ্রাণিত হলেও, এটি ভারতীয় আত্মীকরণে অনন্য। ২০৪ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি মূলত রামগড় নামের একটি কাল্পনিক গ্রামে দুই ছোটখাটো মাস্তান জয় ও বীরুর (অমিতাভ বচ্চন ও ধর্মেন্দ্র) গল্প। তাঁরা একজন সাবেক জেলার, ঠাকুর বলদেব সিং-এর ভাড়াটে নিযুক্ত হন কুখ্যাত ডাকাত গব্বর সিংকে দমন করার জন্য। গব্বর সিং ভারতীয় সিনেমার অন্যতম আইকনিক খলনায়ক।
মুক্তির পর, মুম্বাইয়ের ১ হাজার ৫০০ আসনের মিনার্ভা থিয়েটারে ছবিটি টানা পাঁচ বছর প্রদর্শিত হয়। বিবিসি ইন্ডিয়ার অনলাইন জরিপে এটিকে ‘সহস্রাব্দের সেরা চলচ্চিত্র’ এবং ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের জরিপে ‘সর্বকালের সেরা ভারতীয় চলচ্চিত্র’ হিসেবে নির্বাচিত হয়। আর. ডি. বর্মনের সংগীত এবং ছবির সংলাপের ৫ লাখ রেকর্ড ও ক্যাসেট বিক্রি হয়েছিল।
গব্বর সিং চরিত্রে আমজাদ খান। ছবি: সিপ্পি ফিল্ম
‘শোলে’ শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ফেনোমেনা। এর সংলাপ এখনো বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে উদ্ধৃত হয়, রাজনৈতিক বক্তৃতায় ব্যবহৃত হয়, বিজ্ঞাপনে প্যারোডি করা হয়। ছবিতে একটি ছোটখাটো মাস্তানের চরিত্রে অভিনয় করা ধর্মেন্দ্র সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শোলে হলো বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য।’ অমিতাভ বচ্চন ছবিটি শুটিংয়ের অভিজ্ঞতাকে ‘অবিস্মরণীয়’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘যদিও তখন আমার কোনো ধারণা ছিল না যে এটি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত হয়ে উঠবে।’
পুরো সিনেমাটি যেভাবে পুনরুদ্ধার করা হলো
ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুর জানিয়েছেন, এই নতুন সংস্করণটিই ‘শোলে’র সবচেয়ে অথেনটিক রূপ। কারণ এতে সিনেমার প্রকৃত সমাপ্তি এবং আগে কখনো না দেখা বাদ পড়া দৃশ্যগুলো রয়েছে।
হলিউডের ওয়েস্টার্ন ও জাপানের সামুরাই ঘরানার ছাড়া অবলম্বনে হলেও ভারতীয় হিসেবেও এই সিনেমার অনন্য। ছবি: সিপ্পি ফিল্ম
মূল গল্পে, ঠাকুর গব্বরকে তাঁর কাঁটাযুক্ত জুতো দিয়ে পিষে মেরে ফেলে। কিন্তু সেন্সর বোর্ড এতে আপত্তি জানায়। একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন, এই ধারণায় তাঁরা আপত্তি করেন। তাঁদের কাছে ছবির স্টাইলিশ সহিংসতাও অতিরিক্ত মনে হয়েছিল। জরুরি অবস্থার সময় ছবিটি মুক্তি পাওয়ায় সেন্সরের কড়াকড়ি ছিল অনেক বেশি।
সেন্সর বোর্ডের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হলে, পরিচালক সিপ্পিকে সমাপ্তি দৃশ্যটি পুনরায় শুট করতে বাধ্য করা হয়। অভিনেতাদের নিয়ে দ্রুত দক্ষিণ ভারতের রামানাগারাম-এর পাহাড়ে ফিরে যেতে হয়। এটিই ছবিতে রামগড় গ্রাম। নতুন এবং অপেক্ষাকৃত কম সহিংস সমাপ্তিতে গব্বর সিংকে হত্যা না করে বন্দী করা হয়। এরপরই ছবিটি সেন্সরের ছাড়পত্র পায়।
এই মহাকাব্যিক চলচ্চিত্রটির তিন বছরের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া মোটেও সহজ ছিল না। ছবির মূল ৭০ মিলিমিটারের প্রিন্টগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ক্যামেরার নেগেটিভগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ছিল।
২০২২ সালে, রমেশ সিপ্পির ছেলে শেহজাদ সিপ্পি ছবিটি পুনরুদ্ধার করার প্রস্তাব নিয়ে মুম্বাই-ভিত্তিক ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের কাছে যান। তিনি জানান, ছবির কিছু উপাদান মুম্বাইয়ের একটি গুদামে সংরক্ষিত আছে। এটি প্রথমে একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ মনে হলেও, পরে প্রায় অলৌকিকভাবে মিলে যায়: লেবেলবিহীন ক্যানগুলোর ভেতর পাওয়া যায় আসল ৩৫ মিলিমিটারের ক্যামেরা ও সাউন্ড নেগেটিভ!
মুম্বাইয়ের মিনার্ভার থিয়েটারের দর্শকদের ভিড়। ছবি: সিপ্পি ফিল্ম
সিপ্পি ফিল্মস ফাউন্ডেশনকে জানায়, যুক্তরাজ্যের একটি গুদামেও অতিরিক্ত রিল সংরক্ষিত আছে। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সহায়তায়, দলটি সেই আর্কাইভের উপাদানগুলো সংগ্রহ করে। এরপর সেগুলো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বোলোগনার এল’ইমাজিন রিট্রোভাটা-তে পাঠানো হয়। এটি বিশ্বের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র পুনরুদ্ধার কেন্দ্র।
আশ্চর্যের বিষয়, মুক্তির প্রথম দিকে ‘শোলে’র যাত্রা মসৃণ ছিল না। প্রাথমিক রিভিউগুলো ছিল নেতিবাচক, বক্স অফিস ছিল নড়বড়ে, ৭০ মিলিমিটারের প্রিন্ট কাস্টমসে আটকে গিয়েছিল।
ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিন ছবিটি সম্পর্কে লিখেছিল ‘একটি নিভে যাওয়া অঙ্গার’। ফিল্মফেয়ার-এর বিক্রম সিং লিখেছিলেন, ছবির মূল সমস্যা ছিল ‘ব্যর্থ প্রচেষ্টা, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে একটি ওয়েস্টার্ন সিনেমা জুড়ে দেওয়া চেষ্টা করা হয়েছে।’ প্রাথমিক প্রদর্শনীতে দর্শকেরা নীরব ছিলেন—কোনো হাসি, কান্না বা করতালি ছিল না। চলচ্চিত্র লেখক অনুপমা চোপড়া তাঁর ‘শোলে: দ্য মেকিং অব অ্যা ক্ল্যাসিক’ বইয়ে লিখেছেন, ‘শুধু নীরবতা।’ সপ্তাহান্তে প্রেক্ষাগৃহগুলো পূর্ণ হলেও দর্শকদের প্রতিক্রিয়া অনিশ্চিত ছিল। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল।
পরের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দর্শকেরা ছবিটি গ্রহণ করতে শুরু করেন এবং মুখে মুখে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অনুপমা চোপড়া লিখেছেন, ‘ভিজ্যুয়ালগুলো ছিল মহাকাব্যিক এবং শব্দ ছিল জাদুকরী…তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে দর্শকেরা সংলাপগুলো আওড়াচ্ছিল। এর মানে হলো, কিছু দর্শক অন্তত দ্বিতীয়বারের মতো ছবিটি দেখতে আসছিল।’
‘শোলে’ মুক্তির এক মাস পর, পলিডর একটি ৪৮ মিনিটের সংলাপ রেকর্ড প্রকাশ করে—এবং পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ছবির চরিত্রগুলো আইকনিক হয়ে ওঠে। গব্বর সিং—এক ‘সত্যিই ভীতিকর, কিন্তু ব্যাপক জনপ্রিয়’ খলনায়ক—একটি সাংস্কৃতিক ফেনোমেনা হিসেবে আবির্ভূত হন। বিদেশি সমালোচকেরা এটিকে ভারতের প্রথম ‘কারি ওয়েস্টার্ন’ বলে অভিহিত করেন।
মুম্বাইয়ের মিনার্ভা থিয়েটারে ‘শোলে’ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল—তিন বছর নিয়মিত শোতে এবং দুই বছর ম্যাটিনি শোতে। এমনকি ২৪০ তম সপ্তাহেও শো ছিল হাউসফুল। ২০১৫ সালের এপ্রিলে, ৪০ বছর পুরোনো হওয়া সত্ত্বেও, ‘শোলে’ পাকিস্তানের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় এবং ২০০২ সালের ‘দেবদাস’-এর মতো এক দশকেরও বেশি পুরোনো বেশির ভাগ ভারতীয় ছবিকে ছাপিয়ে যায়।
পঞ্চাশ বছর পরেও কেন ‘শোলে’ দর্শকদের মন জয় করে চলেছে? অমিতাভ বচ্চন এক সাক্ষাৎকারে এর একটি সহজ, কিন্তু গভীর উত্তর দিয়েছেন: ‘ভালো এবং মন্দের জয়… এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিন ঘণ্টার মধ্যে পয়েটিক জাস্টিস! যা আপনি এবং আমি সারা জীবনেও পাব না।’