সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছে স্ট্যান্ডআপ কমেডি অনুষ্ঠান। এই ‘রিয়াদ কমেডি ফেস্টিভ্যালে’ মানুষ অভূতপূর্ব কিছু ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে। রক্ষণশীল দেশটির সামাজিক কাঠামোতে নতুন পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে এমন আয়োজন। তবে এমন আয়োজনের রাজনৈতিক ও নৈতিক ভিত্তি নিয়ে বিশ্বজুড়ে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে। পশ্চিমা তারকা কমেডিয়ানদের পারফর্ম করা অশ্লীল, যৌনতা ও ট্রান্সজেন্ডার-সম্পর্কিত কৌতুক স্থানীয় দর্শকদের হতবাক করেছে। সেই সঙ্গে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমা তারকাদের সেখানে পারফর্ম করা বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে।
ফেস্টিভ্যালের পারফরম্যান্সে আমেরিকান তারকা ডেভ চ্যাপেল ও বিল বারের মতো জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতারা যৌনতা, সমকামিতা ও ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের নিয়ে এমন খোলামেলা কৌতুক পরিবেশন করেন, যা সাধারণত সৌদি আরবের মতো অতি-রক্ষণশীল সমাজে সম্পূর্ণ ‘হারাম’ বা নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত।
রিয়াদের এক বাসিন্দা জাইন (ছদ্মনাম) বিবিসিকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে সৌদি আরবে প্রকাশ্যে এমন বিষয় নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। বিল বারের উদ্বোধনী পর্বে প্রায় ১০ মিনিট শুধু যৌনতা নিয়েই কৌতুক ছিল।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, সৌদি আরবে সমকামিতা নিষিদ্ধ, মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। এখানকার অনেক দর্শক জীবনে কখনো এমন খোলামেলা স্ট্যান্ডআপ কমেডি দেখেননি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই কৌতুকগুলো সেখানে উপস্থিত স্থানীয় অধিকাংশ সৌদি নারী বেশ উপভোগই করেছেন। আরেক প্রবাসী সারা (ছদ্মনাম) মন্তব্য করেন, উপসাগরীয় এই রাষ্ট্রে এমন কৌতুক শোনা ‘সত্যিই অস্বাভাবিক’!
গ্যাব্রিয়েল ইগলেসিয়াসের শো ছিল হাউসফুল। ছবি: এক্স
এই উৎসবে অংশ নেওয়ায় জিমি কার, জ্যাক হোয়াইটহল, কেভিন হার্ট, রাসেল পিটার্স ও অমিদ জালিলির মতো জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা বিশ্বব্যাপী তাঁদের সহকর্মীদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। বহু শিল্পী এই নৈতিক বিতর্কের কারণে উৎসবের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানও করেছেন।
তবে অনেক কমেডিয়ান অকপটে স্বীকার করেছেন, বিপুল অঙ্কের পারিশ্রমিকই তাঁদের সৌদি আরবে টেনে এনেছে। মার্কিন কমেডিয়ান টিম ডিলন দাবি করেন, তাঁকে শুধু একটি সেটের জন্য ৩ লাখ ৭৫ হাজার ডলারেরও (প্রায় তিন কোটি টাকা) বেশি পারিশ্রমিকের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। অন্য তারকাদের লাখ লাখ ডলারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি মন্তব্য করেন, ‘তারা আমাকে যথেষ্ট টাকা দিচ্ছে যেন আমি অন্যথা না ভাবি।’
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) অভিযোগ করেছে, সৌদি শাসকগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভিন্ন মত দমনের ঘটনাগুলো ‘ধামাচাপা’ দেওয়ার একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা হিসেবে আন্তর্জাতিক তারকাদের এনে কমেডি শো করা হচ্ছে।
এই আয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কৌতুক অভিনেতারা মঞ্চে সৌদি আরবের বিতর্কিত মানবাধিকার রেকর্ড, সরকারের সমালোচনা বা ভিন্ন মত দমনের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।
মানবাধিকারকর্মীরা শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানালেও, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষক জোয়ি শিয়া বলেন, তিনি মঞ্চে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো অভিনেতাকে এই বিষয়ে কথা বলতে দেখেননি। ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে এই ফেস্টিভ্যাল। চলবে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত। এই ফেস্টিভ্যালের সময়ের সঙ্গে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার সপ্তম বার্ষিকী মিলে যায়। মার্কিন কমেডি তারকা মার্ক ম্যারন এক স্ট্যান্ডআপ ক্লিপে কৌতুক করে এই নৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
এ ছাড়া, কমেডিয়ান আৎসুকো ওকাৎসুকা দাবি করেছেন, চুক্তির শর্তে রাজপরিবার বা ধর্মের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বা অবমাননাকর হয়—এমন কোনো উপাদান ব্যবহার করায় নিষেধাজ্ঞা ছিল।
অন্যদিকে, রিয়াদের স্থানীয় মানুষ ও প্রবাসীরা দেশের এই সামাজিক পরিবর্তনে দারুণ উৎসাহিত। সারা (ছদ্মনাম) নামের এক প্রবাসী বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে পশ্চিমা বিশ্বে অনেকে এটিকে সমর্থন করবে না, কিন্তু এখানকার মানুষ রূপান্তর কর্মসূচি নিয়ে সত্যিই উচ্ছ্বসিত।’
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে সৌদি আরব তাদের ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খনিজ তেলনির্ভরতা কমাতে বিনোদন, পর্যটন এবং খেলাধুলার মতো খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। স্থানীয়রা মনে করছেন, এমন একটি উৎসব জনগণের চোখ খুলে দিতে সাহায্য করছে, সমাজে একটি নতুন ধরনের খোলামেলা আলোচনা শুরুর ক্ষেত্র তৈরি করছে।
বিল বার তাঁর পারফরম্যান্সের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, দর্শকেরা সত্যিকারের স্ট্যান্ডআপ কমেডি দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে, এটি ইতিবাচক ফল আনবে। স্থানীয় অধিবাসী জাইনও মনে করেন, সরকার নিয়ে কৌতুক করা না গেলেও, এই ইভেন্ট জনগণের চোখ খুলতে সাহায্য করছে।